শনিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বিলীন হচ্ছে তুরাগের অস্তিত্ব

বিআইডব্লিউটিএর উদ্যোগ বাস্তবায়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন জনমনে

আফজাল, টঙ্গী

বিলীন হচ্ছে তুরাগের অস্তিত্ব

দিনকে দিন অস্তিত্ব হারাচ্ছে তুরাগ নদ। দখল, দূষণ আর নাব্য সংকটই এর মূল কারণ। ঢাকা নদীবন্দর (বিআইডব্লিউটিএ) কর্তৃপক্ষের নদের দখল ও দূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু নদের ধারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও বনায়ন সৃষ্টি করে অস্তিত্ব ফিরে পাওয়া যাবে না। প্রথমে দূষণ রোধ, এরপর দখল ও সরাসরি প্লাস্টিক বর্জ্য নদে না ফেলার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরেজমিনে গিয়ে নদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে, এ যেন ময়লার ড্রেন! পাশের ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে নাক চেপে। আর নদে প্রবাহিত ময়লা-আবর্জনার পচা পানির দুর্গন্ধে নাকাল চলাচলকারীরা। তাই প্রথমে পানি পরিষ্কারের ব্যবস্থা এবং নৌ চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। নদের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে বিআইডব্লিউটির পক্ষ থেকে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও আসলে এর কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন জনমনে।

যমুনা নদী জামালপুরে শেষ হয়ে টাঙ্গাইল অংশে প্রবেশ করে ভুয়াপুর, গোপালপুর অঞ্চল থেকে পূর্ব দিকে টাঙ্গাইল জেলার মধ্য দিয়ে সখীপুর, মির্জাপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বংশী নদী নাম ধারণ করে যমুনার শাখানদী হিসেবে প্রবহমান। এই বংশী নদী গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাইর এলাকায় এসে দুই ভাগে ভাগ হয়ে এক ভাগ দক্ষিণে সাভারের ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিলেছে। অন্যটি তুরাগ নাম ধারণ করে বরইবাড়ী, বোয়ালী, চা-বাগান, মির্জাপুর, কাউলতিয়া, মধ্যপাড়া, কোনাবাড়ী, বামন, কাশিমপুর, গাছা, ইয়ারপুর, আশুলিয়া উত্তরা (তুরাগ থানা) বিরুলিয়া, মিরপুর হয়ে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রবহমান। তুরাগের প্রবাহকালে ইছরকান্দি এলাকায় এসে এটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে প্রবাহিত হতে থাকে, যার পূর্ব দিকে প্রবাহিত শাখা সাবেক টঙ্গী পৌরসভার ভাদাম ও ভাকরাল। এই ভাদাম ও ভাকরালকে আবার দুই ভাগে ভাগ করে মুদাফা বড়দেওড়াকে উত্তরে রেখে বিশ্ব ইজতেমার পশ্চিমে কহর দরিয়া নামকরণ করে বালু নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। একসময় এই তুরাগ নদ দিয়ে নৌ-যান চলাচল করত। এই নদের পানি দিয়ে গোসল কিংবা রান্নাবান্না করত লোকজন। নদে অনেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন গোসল বা পানি ব্যবহার তো দূরের কথা, ময়লা-আবর্জনার পচা গন্ধে নদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো কষ্টসাধ্য। একসময় বিভিন্ন এলাকার মানুষ ট্রলারে করে ঐতিহ্যবাহী টঙ্গী বাজারে আসত কেনাকাটা করতে। চলাচলের সুবিধার্থে টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় কয়েক বছর আগে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় নদীবন্দর। দখল, দূষণ আর নাব্য সংকটে তুরাগ নদ সরু হওয়ার ফলে নদীবন্দরটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর। এতে টঙ্গী নদীবন্দর অনেকটাই মাদকসেবীদের আড্ডায় পরিণত হয়েছে। গাজীপুর পুবাইল উলুখোলার বাসিন্দা টঙ্গী সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ওয়াদুদুর রহমান বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে ট্রলারে করে টঙ্গী বাজারে আসতাম বাজার করতে। সেই নদের পানি এখন আর নেই। পানিতে ময়লা-আবর্জনা আর দুর্গন্ধের কারণে এখন অনেকেই টঙ্গী বাজারে আসেন না বাজার করতে। নৌকা দিয়ে পার হওয়ার সময় পানির দিকে তাকালে মনে হয়, ময়লার ড্রেন দিয়ে চলাচল করছি। বছরের পর বছর ধরে একই চিত্র নদের।’ টঙ্গী বাজার এলাকার বাসিন্দা ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন সরকার বলেন, নদের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে দূষণরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এরপর খননকাজ করতে হবে। ওয়াকওয়ে করে কী লাভ, পচা পানির উৎকট গন্ধে মানুষ নদের পাশ দিয়ে হাঁটতে না পারলে? বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক কালিমুল্লাহ ইকবাল বলেন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদফতর, বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতার অভাব। নেই দখল ও দূষণরোধে যথাযথ ভূমিকা। এ ছাড়া শিল্পমালিকরা কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নদে ফেলে পানিকে দূষিত করছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি নেই। ফলে নদের অস্তিত্ব দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে ঢাকা নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, নদের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা যেন নদে প্রবাহিত হতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং খননকাজ চলমান রয়েছে। বিভিন্ন কারখানার মালিকরা তাদের কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য নদে ফেলে পানি দূষিত করছেন। নদের পরিবেশ নষ্ট করছেন। তবে নদী বাঁচাতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। গাজীপুর পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক আবদুস সালাম সরকার বলেন, কিছু ওয়াশিং ও ডাইং কারখানার মালিকের ইটিপি আছে। কিন্তু অনেকেরই নেই। যারা বিষাক্ত তরল বর্জ্য নদীতে ফেলছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।

সর্বশেষ খবর