মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দেশটির সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর এখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পার্শ্ববর্তী এই দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ কম হলেও গুরুত্বপূর্ণ। গত দুই বছর ধরে পিঁয়াজ সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমারের পিঁয়াজের ওপর নির্ভর করছে সরকার। দেশে খাদ্যপণ্যের মজুদ কমে যাওয়ার পর, চালের দামে যখন ঊর্ধ্বগতি, তখন গত জানুয়ারিতে সরকার মিয়ানমার থেকে জি টু জি ভিত্তিতে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। এখন নির্বাচিত সু চি সরকারের পতনের পর কী হবে সেই চাল আমদানির- তা নিয়ে সরকারের মধ্যে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, চাল আমদানি স্থগিত। তবে এটি সত্য নয় বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম।
বাংলাদেশকে চাল দেবে মিয়ানমারের সামরিক সরকার : গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে খাদ্য সচিব জানান, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চাল আমদানি নিয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। দেশটি বাংলাদেশকে চাল দেবে। এদিকে গতকাল বিকালে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রীর বরাত দিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মিয়ানমারে ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ায় সরকারের সঙ্গে ১ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে পুনরায় নিশ্চিত করেন, চাল নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যটি সঠিক নয়। সচিব জানান, তুরস্ক থেকেও কোনো এক ব্যক্তি চাল আমদানি স্থগিতের বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন। সেখানেও তিনি একই কথা বলেছেন। অর্থাৎ চাল আমদানি স্থগিতের বিষয়টি মিথ্যা।সচিব বলেন, মিয়ানমার থেকে চাল আমদানির বিষয়ে এখনো কোনো অনিশ্চয়তা দেখা যায়নি। সরকার পরিবর্তন হলেও রাজনৈতিকভাবে তারা কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। ফলে এই (১ লাখ টন চাল) প্রকিউরম্যান্টে কোনো প্রভাব পড়বে না। খাদ্য সচিবের এই বক্তব্য নিয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, চাল আমদানির বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আমি বলেছি, মিয়ানমারের এখন চাল রপ্তানির আগ্রহ আছে কিনা বা আমরাও এ পরিস্থিতিতে কীভাবে আমদানি করব, এসব বিষয় বিবেচনা করে চাল আমদানি নিয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। আমরা এ বিষয়ে ধীরে এগোচ্ছি। অর্থমন্ত্রী বলেন, জরুরি প্রয়োজন পড়লেই আমরা মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি করি। এর আগে পিঁয়াজ এনেছি। এখন মিয়ানমারে সরকার পরিবর্তনের পর পশ্চিমা দেশগুলো দেশটির ওপর কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেদিকে আমাদের নজর আছে। তাদের সিদ্ধান্ত দেখেই চাল আমদানির বিষয়ে এগোতে হবে।
গত বছরের বন্যায় ফসলের ক্ষতি এবং করোনা মহামারীর কারণে ত্রাণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের কারণে চালের দেশে খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে। ফলে বাজারে চালের মূল্য অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারত থেকে জরুরি ভিত্তিতে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকেও জি টু জি (সরকার ও সরকার) পদ্ধতিতে ১ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়।
মিয়ানমার সংকটে সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ : এদিকে মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কারণে দেশটিতে পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হলে সে থেকে বাংলাদেশ সুযোগ নিতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ফলে দেশটিতে পশ্চিমা দেশগুলো বিনিয়োগের যে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, সেই বিনিয়োগগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তরের সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য খুব বেশি নয়। ফলে সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কারণে এই বাণিজ্য বাংলাদেশে কতটা প্রভাব ফেলবে সেটি এখনো বলার মতো সময় আসেনি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত কী সুবিধা পাবে : মিয়ানমার সংকটের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত কোনো বাড়তি সুবিধা পাবে বলে মনে করছেন না এ খাতের উদ্যোক্তা এবং বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
২০১৫ সালে নির্বাচিত সু চি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ফলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ কিছুটা ফিরে আসায় পশ্চিমা বিশ্বের তৈরি পোশাক শিল্পগুলো মিয়ানমারে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে থাকে। ওই সময় কোনো কোনো প্রতিবেদনে আশঙ্কাও করা হয়েছিল যে, অবকাঠামো সুবিধা বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল ও গ্যাস বিদ্যুতের সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ মিয়ানমারে চলে যেতে পারে। তবে গত পাঁচ বছরে এ কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। দেশটিতে ৩-৪ বিলিয়ন বিদেশি বিনিয়োগ তদারকি করছে সরকারি সংস্থা ভ্রিয়েনস অ্যান্ড পার্টনারস। এগুলো মূলত অবকাঠামো খাত, শক্তি খাত ও টেলিযোগাযোগ খাতের বিনিয়োগ। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মিয়ানমারে পশ্চিমা বিনিয়োগ খুব একটা নেই। যেসব বিনিয়োগ আছে তার বেশির ভাগই চীনের। মিয়ানমার সংকটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ খুব একটা আছে বলে মনে করেন না তিনি। বিকেএমইএর এই নেতা বলেন, এর আগে ২০১০ সালে জাপানসহ পশ্চিমা কোম্পানিগুলো যখন চায়না প্লাস সুবিধায় বিনিয়োগ স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিল, আমরা সেটি ধরতে পারিনি। জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করলেও সে সুযোগ নেওয়া যায়নি। কারণ দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য যে পরিমাণ গ্যাস-বিদ্যুৎ অবকাঠামো দরকার তার অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ইজি অব ডুয়িং বিজনেসে। সরকার বিনিয়োগ সেবাগুলো এক ছাতার নিচে আনার উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের জটিলতায় বিনিয়োগকারী সেই সুযোগ পাচ্ছেন না।