ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহজ করতে গত পাঁচ বছর ধরে দুটি আইন সংস্কারের সুপারিশ করে আসছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে একটি ছিল দেউলিয়া আইন ও অপরটি সিকুউরড ট্রানজেকশন ল। এখন এ দুটি আইন সংস্কারের বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে সরকারের মধ্যে। শুধু তাই নয়, চলমান লকডাউনের মধ্যেও গতকাল মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে দেউলিয়া আইনের খসড়া জমা দিতে হবে।
জানা গেছে, সরকারের জন্য দেউলিয়া আইনের খসড়াটি তৈরি করছে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন। তারাই এটি করে উল্লিখিত সময়ের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-কে দেবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পাচার করে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নামে-বেনামে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেরাই ঋণ নিয়ে গ্রাহকের শত শত কোটি টাকার আমানত ঝুঁকিতে ফেলছেন কেউ কেউ। দেউলিয়া আইনের দুর্বলতার কারণে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ড করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। আবার প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও আইনি জটিলতায় আটকে থাকছেন বছরের পর বছর।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে দেউলিয়া আইনটি থাকলেও কেউ এর সুযোগ নিতে চান না। অনেক প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে যায় তবুও নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে না। আবার আইনি দুর্বলতার কারণে দেউলিয়া ঘোষণার আগে কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদনের মাধ্যমে পুনর্গঠন সুবিধাও নিতে পারে না। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাওনাদারদের শেষ অশ্রয়স্থল হিসেবে দেউলিয়া আইনের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে, যা প্রচলিত আইনে সুস্পষ্ট নয়।
সূত্র জানায়, প্রচলিত দেউলিয়া আইনের সংস্কারে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক মতামতে বলা হয়েছিল, খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রচলিত দেউলিয়া আইন ততটা কার্যকর নয়, যতটা কার্যকর অর্থঋণ আদালত আইন। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে আর্থিক খাতে সুশাসন কায়েম করার জন্য দ্রুত দেউলিয়া আইনটির সংশোধন জরুরি বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
সূত্রগুলো জানায়, বাণিজ্য সহজীকরণ বা ‘ইজি অব ডুয়িং বিজনেস’-এ বাংলাদেশের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর ইমপ্লিমেন্টেশন অব ডোয়িং বিজনেস রিফর্মস কমিটি’ রয়েছে। ওই কমিটির গতকালের বৈঠকে দেউলিয়া আইনসহ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব নীতিগত সংস্থার প্রস্তাব রয়েছে সেগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব ছাড়াও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান অংশ নেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সভায় দেউলিয়া আইন ও সিকুউরড ট্রানজেকশন আইনসহ বেশ কিছু পলিসি সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে দেউলিয়া আইনটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কারের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি জানান, আগামী ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে এই দেউলিয়া আইনের খসড়া জমা দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক গ্রুপ আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন)-কে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, দেউলিয়া আইনে দুর্বলতার কারণে বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও আইনটি সংস্কারের সুপারিশ রয়েছে। এমন কি বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে ১১টি ইস্যুকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে সংস্কারের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তার মধ্যে এই দেউলিয়া আইন সংশোধনের বিষয়টি রয়েছে। ফলে এই আইনটি সংস্কার করতে পারলে ইজি অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের রেটিং বাড়বে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি কাটিয়ে তোলার জন্য প্রণোদনার পাশাপাশি নীতি সংস্কারের বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া ইজি অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০-এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দেউলিয়া আইন ও সিকুউরড ট্রানজেকশন আইন সংস্কার করলে ব্যবসায় সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের রেটিংয়ে বড় ধরনের উন্নতি ঘটবে, যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়াবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও আস্থা বাড়বে।
সভায় উপস্থিত সূত্রগুলো জানায়, মহামারীকালীন সময়ে বিদেশের অনেক কোম্পানি ব্যবসায় খরচ কমাতে বাংলাদেশের মতো সস্তা শ্রমের দেশগুলোতে তাদের বিনিয়োগ স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছেন। ভারত ও মিয়ানমার থেকে তৈরি পোশাক খাতের অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে আসছে। উপরন্তু সূ চি সরকারের সময় যেসব বহুজাতিক সংস্থা মিয়ানমারে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল, তারাও এখন সামরিক সরকারের কারণে সেগুলো পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে স্থানান্তর করতে চাইছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের ক্ষেত্রে নীতিগত সংস্কারে গুরুত্ব দিয়ে সরকার বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে।