কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণে অবশ্যই করণীয় বা কমপ্লায়েন্স কতটুকু মেনে চলা হয়, সে ক্ষেত্রে পোশাক খাতের বাইরে যে কারখানাগুলো পরিদর্শনের আওতায় এসেছে তার ৫০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ ধরনের কারখানার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও তা হাজারের ওপরে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। শ্রমিক নেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদেশি ক্রেতা এবং আন্তর্জাতিক চাপে পোশাক কারখানাগুলোতে অগ্নিনির্বাপণসহ নিরাপত্তা ইস্যুতে নজর দেওয়া হলেও পোশাক খাতের বাইরে থাকা দেশের অন্য খাতগুলোর কারখানায় শ্রমিকের নিরাপদ কর্মপরিবেশের ব্যাপারে মালিকদের আগ্রহ নেই। ফলে এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের করুণ মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ সম্পদেরও ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিক তদারকির অভাব, মালিকদের মুনাফার লোভ এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উৎকোচের প্রবণতা এসব খাতের শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। গত কয়েক বছরে অগ্নিকান্ডে কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় ১৯ জন এবং গাজীপুরের ফ্যান কারখানায় ১০ জন শ্রমিক নিহত হন। এ ছাড়াও চলতি বছরের ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এর আগে চলতি বছরেই গাজীপুরের শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ এলাকায় আজিজ কেমিক্যাল গ্রুপের এ এস এম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি লিমিটেডে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একজন নিহত এবং ১৬ জন আহত হন। এসব কারখানার বেঁচে যাওয়া শ্রমিক ও উদ্ধারকাজে জড়িত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কাছ থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনায় পতিত এই কারখানাগুলোতে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সেখানে পর্যাপ্ত দরজা ও সিঁড়ি দেখা যায়নি। অগ্নিনির্বাপণেও এসব কারখানায় নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। অনেক কারখানায় নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানার ছয়তলা ভবনটিতে অগ্নিকান্ডের পর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা দেখতে পান যে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছাড়া সেখানে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি ভবনে ওপরে ওঠার দুটি সিঁড়িও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ভবন ও কারখানার লিফট ঘিরে ওঠা সিঁড়িগুলো একেবারেই ব্যবহারের উপযোগী নয়। এমনকি ভবনটির ছাদে ওঠার রাস্তা কলাপসিবল গেট ও নেট দিয়ে আটকানো ছিল।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ঢাকাসহ সারা দেশে দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে হাজারেরও বেশি কারখানা। সেখানে যেমন নেই কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা তেমনি নেই পর্যাপ্ত সিঁড়ি। এসব কারখানায় নিয়মিত নজরদারিও করা হয় না। আর এ কারখানাগুলো ঢাকা, টঙ্গী, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এলাকায় অবস্থিত। এসব কারখানার মধ্যে আছে কেমিক্যাল কারখানা, প্রসাধনী কারখানা বিস্কুট, জুস, ফুড কারখানা, ইলেকট্রনিক্স কারখানা এবং টেক্সটাইল মিল ইত্যাদি। সংস্থাটির তথ্যে, ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা তৈরি করতে বারবার বলা হলেও ভবন মালিকরা তা শোনেন না। ভবন নির্মাণের পর ফায়ার সার্ভিস থেকে অগ্নিঝুঁকি নেই এমন ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও অনেকে এটি মানছেন না। অনেক কারখানায় অগ্নিকান্ড থেকে বাঁচতে শ্রমিকদের মহড়ার ব্যবস্থা করা হয় না।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অর্জিত হয় পোশাক কারখানার মাধ্যমে। পোশাক খাতের সঙ্গে আইএলও, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও বাইরের ক্রেতাদের সম্পৃক্ততা আছে। এই খাতের সঙ্গে তাদের ব্যবসা অনেকাংশে জড়িত। এজন্য শ্রমিকের কথা চিন্তা না করলেও ব্যবসার খাতিরে এ খাতে উন্নত পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে মালিকরা আগ্রহী। ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়েই তারা কমপ্লায়েন্সে আগ্রহী। কিন্তু অন্য খাতগুলো আমাদের অর্থনীতি এবং রপ্তানিতে তেমন বড় খাত হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায় এখনো এই খাতের শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় মালিকপক্ষ সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। একটি কারখানায় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদির জন্য যে অর্থ ব্যয় হয় তার তুলনায় যে জরিমানা করা হয় তা খুবই সামান্য।শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করেই দেশের কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স ঠিক করে দেওয়া হয়। দেখা যাচ্ছে যে, নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে কারখানাগুলোর ভবন যেভাবে তৈরির কথা তা করা হচ্ছে না। কারখানা স্থাপন করার জন্য অন্তত ২৩টি বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হয়। আর এ কারখানাগুলো নিয়মিত নজরদারি করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। বরং খামের দামে শ্রমিকের জীবন বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। পরিদর্শকদের মোটা খামের বিনিময়ে মালিকরা মনগড়া প্রতিবেদন নিয়ে নেন। পোশাক খাতে নজর বেশি হওয়ায় সেখানে মালিকরা কারখানা কমপ্লায়েন্স মানছেন। কিন্তু যে কারখানাগুলো নজরের আড়ালে সেখানে ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটতে দেখছি।
তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন- নতুন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০২০ (বিএনবিসি)-এর কারণে কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনার হার আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। নতুন এই কোডে ১০ তলা পর্যন্ত কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ইস্যুর ব্যাপারে যথাযথ দিকনির্দেশনা নেই। এই বিএনবিসিতে ৩৩ মিটার পর্যন্ত ছাড় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নতুন বিল্ডিং কোডের দোহাই দিয়ে যথাযথ নিরাপত্তা না মেনেই অনেকে কারখানা ভবন তৈরি করছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগে. জে. মো. সাজ্জাদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পোশাক খাত ছাড়া অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের মধ্যে যে কারখানাগুলো আছে সেগুলোর ওপর রপ্তানির চাপ না থাকায় কমপ্লায়েন্স ইস্যুটিকে মালিকরা গুরুত্ব দেন না। এ ব্যাপারে কারখানা মালিকদের বারবার সচেতন করা হলেও তারা উদাসীন। হাসেম ফুড কর্তৃপক্ষকে আমরা বারবার নোটিস করেছি। আমাদের চাপে তারা অগ্নি প্রতিরোধে পরিকল্পনা তৈরি করলেও সেটা বাস্তবায়ন করেনি।
কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে কমিটি গঠন : দেশের কল-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার একটি কমিটি গঠন করছে। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ-বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এই কমিটির নেতৃত্ব দেবেন। গত শুক্রবার ১৬ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সালমান এফ রহমান এমনটি জানান। তিনি জানান, দেশের সব শিল্প-কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ, ভবনের কাঠামো ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়ে সরকার আলাদা একটি এজেন্সি করার কথা ভাবছে। এ জন্য যদি বিদ্যমান আইনের সংশোধন করতে হয়, প্রয়োজনে তাও করা হবে। কমপ্লায়েন্সে দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রিপোর্ট দেয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের কারখানাগুলোর শ্রম পরিস্থিতি, আইনগত বিষয়সহ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে কমিটি দ্রুত প্রতিবেদন দেবে। এর ভিত্তিতে পরবর্তী উদ্যোগ নেওয়া হবে।