রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনের পর ট্রাংকে লাশ পাঠান ঢাকায়

রহস্য উদঘাটন ছয় বছর পর

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে ঈগল পরিবহনের একটি বাসে ছয় বছর আগে এক তরুণীর ট্রাংকভর্তি লাশ পাওয়া যায়। পরিচয় না পাওয়ায় লাশটি অজ্ঞাত হিসেবে উল্লেখ করে পুলিশ। পরে এ ঘটনায় দারুস সালাম থানার এসআই জাহানুর আলী বাদী হয়ে ২০১৫ সালের ৩ মে মামলা করেন। মামলা হওয়ার পর শুরুতে প্রায় তিন মাস তদন্ত করে থানা পুলিশ। এরপর ঘটনার তদন্ত শুরু করে সিআইডি। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করেও এর রহস্য উন্মোচন হয়নি। মামলাটি লোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর হওয়ায় পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। দুই বছর তদন্ত করে এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও জড়িত আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে শুক্রবার কুমিল্লার ইপিজেড এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তিনি হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

তিনি বলেন, ২০১৫ সালের ৩ মে সকালে চট্টগ্রামে কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট কেটে এক ব্যক্তি একটি ট্র্যাংক বাসে তুলে দেন। এ সময় তিনি হেলপারকে বলেন, সামনের ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে এ টিকিটের যাত্রী উঠবে। কিন্তু পরবর্তী ওই কাউন্টার থেকে যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে এবং বিকালে গাবতলী এসে পৌঁছায়। এরপর বাসের সব যাত্রী তাদের জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যান। পরে হেলপার দেখেন, একটি ট্র্যাংক মালিকবিহীন পড়ে আছে। তখন বাসচালক-হেলপার মিলে ট্র্যাংকটি নামিয়ে দেখেন এটি খুব ভারী। তাদের সন্দেহ হওয়ায় তারা পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে ট্র্যাংকটি খুলে একজন অজ্ঞাত তরুণীর লাশ দেখতে পান। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় অজ্ঞাত হিসেবে লাশটি দাফন করা হয়। ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ভিকটিমকে শনাক্ত করার জন্য সব ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করে পিবিআই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম শহর ও জেলা এলাকার সব থানায় নিখোঁজ জিডির অনুসন্ধান করা হয়। শতাধিক নিখোঁজ জিডির তথ্য উদঘাটন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১০ জুন ৫৯৯ নম্বর একটি জিডিতে দেখা যায়, শম্পা বেগম চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে নিখোঁজ হন। ওই ঘটনায় নিহত শম্পার ভগ্নীপতি আবদুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় জিডি করেন। ওই জিডির সূত্র ধরে আবদুল মান্নান ও নিহত শম্পার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ইলিয়াস শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ভিকটিম শম্পার গ্রামের বাড়ি খুলনার দৌলতপুর থানার দেওয়ানা উত্তরপাড়ায়। এরপর জানা যায়, ২০১৩ সালে অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনী সদস্য রেজাউল করিম স্বপন খুলনা তিতুমীর নৌ-ঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। এ সময় শম্পা হাসপাতালে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতেন। হাসপাতালে ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসার সময় শম্পার সঙ্গে রেজাউলের পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রেম হয়। পরে বিয়ের জন্য চাপ দিলে রেজাউল বদলি হয়ে চট্টগ্রাম চলে যান।

এরপর ভিকটিম শম্পাও কিছুদিন পর তার এক ফুফুর বাসায় থাকা শুরু করেন। তিনি ফয়’স লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে পাহাড়তলী থানার উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে শম্পা ও রেজাউল বসবাস শুরু করেন। এভাবে তারা ২০১৪-২০১৫ সালের মে পর্যন্ত একত্রে বসবাস করেন। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেও তারা বিয়ে করেননি।

পরে তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দিলে শম্পাকে রেজাউল ২০১৫ সালের ২ মে গভীর রাতে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। লাশ গোপন করার উদ্দেশ্যে একটি ট্র্যাংকে ভরে ঈগল পরিবহনের বাসে তুলে দেন রেজাউল। পরে শম্পার বাবাকে রেজাউল জানান, তাকে খুলনার বাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শম্পা বাড়িতে না পৌঁছালে তারা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেন। না পেয়ে ভিকটিমের পরিবার পাহাড়তলী থানায় জিডি করে। ওই বছরই ভিকটিমের বাবা আসামি রেজাউলের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। তার বাহিনী তদন্তে রেজাউলের বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্টতা পায়। পরে ২০১৯ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। মামলাটি হওয়ার পর দারুস সালাম থানা পুলিশ প্রায় তিন মাস তদন্ত করে। এরপর পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে সিআইডি প্রায় চার বছর তদন্ত করে লাশ শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে। তবে আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। পিবিআই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। সেই মামলার রহস্য উন্মোচন করল পিবিআই।

সর্বশেষ খবর