বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
খাদ্য অধিদফতরের পরিদর্শন প্রতিবেদন

কালোবাজারে ওএমএসের চাল-আটা

অনিয়মে আটজনের ডিলারশিপ স্থগিত, চার কর্মকর্তাকে শোকজ, সারা দেশে শিগগিরই ঝটিকা অভিযান

উবায়দুল্লাহ বাদল

রাজধানীর কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডের ওএমএসের (ওপেন মার্কেট সেল) ডিলার আইয়ুব খানের দোকানে হঠাৎ পরিদর্শনে যায় খাদ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক সেলিমুল আজমের নেতৃত্বে পরিদর্শন দল। দোকানে ১৩টি বস্তায় ৩৯০ কেজি চাল ও সাতটি বস্তায় ৩৫০ কেজি আটা পাওয়া যায়নি। এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ডিলার আইয়ুব খান। পরে তিনি স্বীকার করেন ওই চাল-আটা কালোবাজারে বিক্রি করেছেন বেশি দামে। ওই পরিদর্শন দল এর আগে মতিঝিল এজিবি কলোনির ডিলার শাহজাহান বকাউলের ওএমএস ট্রাকসেলে লুকানো ৯টি আটাভর্তি বস্তা উদ্ধার করে। তাদের ডিলারশিপ স্থগিত করে ব্যাখ্যা তলব করেছে খাদ্য অধিদফতর। এমন চিত্র শুধু রাজধানীর মতিঝিল-কমলাপুরে নয়, প্রায় সারা দেশের ওএমএস কার্যক্রমে চলছে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি।

এ কর্মসূচির অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে খাদ্য অধিদফতরের ১৫ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে পাঁচটি পরিদর্শন টিম গঠন করা হয়েছে। তিন সদস্যের প্রতিটি টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন অধিদফতরের একজন করে অতিরিক্ত পরিচালক। এসব টিম প্রতিদিন ওএমএস কেন্দ্রগুলো ঝটিকা পরিদর্শন করে প্রতিবেদন আকারে খাদ্য অধিদফতরের ডিজির কাছে জমা দেবে। গত ১৫ দিনে পাওয়া পরিদর্শন প্রতিবেদনের আলোকে ইতোমধ্যে আটজনের ডিলারশিপ স্থগিত ও চারজন কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডিলারদের কাছ থেকে কমবেশি ১০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে খাদ্য অধিদফতর।

উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করেছেন খাদ্য অধিদফতরের ডিজির দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওএমএসের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলেছি তদারক কর্মকর্তাদের। ইতিমধ্যে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পাঁচটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো কখন কোথায় পরিদর্শনে যাবে তা ওইদিন সকাল ৯টায় আমরা জানিয়ে দিই, যাতে সংশ্লিষ্ট ডিলাররা জানতে না পারেন। এর সুফলও আমরা পেতে শুরু করেছি। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি বেরিয়ে আসছে পরিদর্শনে। আমরা শিগগিরই আট বিভাগে একাধিক টিম গঠন করে ঝটিকা অভিযান পাঠাব। যাদের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও     দুর্নীতি পাওয়া যাবে তাদেরই ডিলারশিপ বাতিলসহ জরিমানা করা হবে। প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

জানা গেছে, স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জন্য কম দামে ওএমএসের (খোলাবাজারে বিক্রি বা ওপেন মার্কেট সেল) চাল ও আটা বিক্রি করছে সরকার। ডিলারদের কাছে ১৮ টাকা কেজি দরে আটা এবং ৩০ টাকায় চাল বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও পৌরসভায় মোট ১ হাজার ৭৬০টি দোকান ও ট্রাকসেলের মাধ্যমে ওএমএস কার্যক্রম চলছে। বাজারমূল্যের প্রায় অর্ধেক দামে কিনতে এসব ওএমএস দোকান ও ট্রাকের সামনে প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে মানুষের সারি। কিন্তু দুপুরের আগেই ডিলারদের প্রতিনিধিরা বলছেন, তাদের চাল-আটা শেষ হয়ে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, গরিব মানুষের কাছে এ চাল বিক্রি না করে তা লুটে নিচ্ছেন ওএমএস দোকান ও ট্রাকের ডিলাররা। খাদ্য বিভাগের তদারক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ চাল কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। খাদ্য অধিদফতরের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ জানুয়ারি অধিদফতরের একটি তদারক দল রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হলে ওএমএসের ট্রাকসেল হঠাৎ পরিদর্শনে যান। এ সময় ডিলার ইব্রাহীম হীরার ট্রাকে ১০টি চাল ও ১২টি আটার খালি বস্তা পাওয়া যায়নি। একই দিন রাজধানীর গ্রিন রোডের ওএমএস ডিলার সাইফুন নাহারের ট্রাকসেল কেন্দ্রে দুই বস্তা চাল ও দেড় বস্তা আটা বেশি পাওয়া যায়। পাশাপাশি চালের ছয়টি ও আটার দুটি খালি বস্তা ট্রাকে মজুদ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ডিলারের পক্ষে যারা চাল-আটা বিক্রি করছিলেন তাদের অনুমতিপত্র ছিল না। একই রোডের অপর ডিলার জাহিদ হাসানের দোকানে গিয়ে ভোক্তার উপস্থিতি পাওয়া না গেলেও মাস্টাররোলে গ্রাহকের অগ্রিম ক্রমিক নম্বর লেখা ছিল। এর আগে ৯ জানুয়ারি দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর বিশ্বরোডের নির্ধারিত স্থানে ডিলার ইয়াসমিন বেগমের দোকান পাওয়া যায়নি। তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই দোকানের স্থান পরিবর্তন করে অন্য একটি জায়গায় অপরিচ্ছন্ন দোকানে ওএমএস কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, যা সংশ্লিষ্ট নীতিমালার পরিপন্থী। এসব চাল ও আটা কালোবাজারে বিক্রি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদারক কমিটির সদস্যরা। ডিলারদের পক্ষে ট্রাকে যারা চাল ও আটা বিক্রি করছিলেন, তাদের কোনো অনুমতিপত্র পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর কাটাসুরের ডিলার মহিউদ্দিনের দোকানে ও মোহাম্মদপুর ময়ূর ভিলার ডিলার মরিয়ম বেগমের ট্রাকে পাওয়া যায়নি মজুদ ও পরিদর্শন রেজিস্ট্রার। বস্তায় বিতরণ করা সিল ছিল সম্পূর্ণ অস্পষ্ট।

এর আগে ৮ ডিসেম্বর নোয়াখালীর সুধারামে কালোবাজারে ওএমএসের চাল-আটা বিক্রি করায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে অর্থদন্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। নোয়াখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে অভিযান চালিয়ে নিজাম উদ্দিন নামে ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে আটক করা হয়। এ সময় তার হেফাজত থেকে ১৭৯ বস্তা চাল, ১৮ বস্তা আটা ও নগদ ৩২ হাজার ৩৯০ টাকা জব্দ করা হয়। পরে আটক ব্যক্তিকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাফিজুল হকের নেতৃত্বে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় দেশের নানা জায়গায় ওএমএসের চাল-আটা কালোবাজারে বিক্রির খবর গণমাধ্যমে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও টনে টনে ওএমএসের চাল উদ্ধার করছেন।

সর্বশেষ খবর