শিরোনাম
বুধবার, ১১ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

অশনির প্রভাবে প্লাবন

নিজস্ব প্রতিবেদক

পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশে আঘাত হানার আশঙ্কা নেই বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। তবে এর প্রভাবে সারা দেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে বয়ে যাচ্ছে ঝড়ো বাতাস। টানা বর্ষণে উপকূলীয় এলাকায় তলিয়ে গেছে অনেক ফসলের খেত। নদ-নদীর পানি বাড়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে বেড়িবাঁধ। তবে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জেলায় জেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ : গতকাল রাতে আবহাওয়া অধিদফতরের ১৪ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার, কক্সবাজার থেকে ১ হাজার ২৭০ কিলোমিটার, মোংলা থেকে ১ হাজার ৩৫ কিলোমিটার ও পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে পরবর্তী ১২ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগর উত্তাল রয়েছে। সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়েছে। অপর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় ও রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা/ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী গতকাল  মধ্যরাত নাগাদ ভারতের উত্তর অন্ধ্র উপকূল এবং ওড়িশার কাছাকাছি পৌঁছাবে অশনি। এরপর বাঁক নিয়ে উত্তর অন্ধ্র এবং ওড়িশা উপকূল ছুঁয়ে এগোতে পারে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে। আজ সকালের মধ্যে এটি দুর্বল হয়ে সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। তাদের মতে, অশনি উপকূল অতিক্রম করে স্থলভাগে আসার আশঙ্কা কম। সাগরেই বৃষ্টি ঝরিয়ে নিম্নচাপে পরিণত হবে। গতকাল দুপুরে বিশাখাপত্তম সৈকত থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে ছিল ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’। এদিকে উইন্ডিডটকমের স্যাটেলাইট চিত্র অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়টি আজ বেলা ১১টার দিকে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের মাছিলিপত্তম বন্দর দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশ করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় আঘাত না হানলেও এরইমধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন খাতে। দিনভর বৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। উপকূলে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে মাঝ ধরা ট্রলারগুলো। টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে অনেক এলাকার ফসলের খেত। নদ-নদীর পানি বাড়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে অনেক এলাকার বেড়িবাঁধ। পথে পথে ভোগান্তিতে পড়েছে ঈদ শেষে কর্মস্থলমুখী মানুষ। ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন আরও তথ্য-

বরগুনায় ফিরে এসেছে তিন শতাধিক মাছ ধরা ট্রলার : ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলে ফিরছে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারগুলো। গতকাল দুপুর পর্যন্ত কেবল বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে তিন শতাধিক ট্রলার ফিরে আসে। ট্রলার মালিকরা বলছেন, ফিরে আসার কারণে ট্রলারপ্রতি দেড় থেকে ২ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে তাদের। ভোলায় ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়েছে : ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে উপকূলীয় এলাকার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। এতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে মরিচ, চিনা বাদাম, মুগডাল, সয়াবিন, সবজি ও তরমুজের খেত। ভোলা কৃষি বিভাগের  ধারণা, এক রাতের বৃষ্টিতে জেলার ১০ হাজার হেক্টর জমির রবিশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরায় ঝুঁকিতে বেড়িবাঁধ : গতকাল দুপুর থেকে সাতক্ষীরায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে-মধ্যে বইছে দমকা হাওয়া। আশাশুনি ও শ্যামনগরের কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, চুনা, রাইমঙ্গলসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ ও ২-এর অধীনে ৪৪টি পয়েন্টের সাড়ে ৮০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন ও জেলা দুর্যোগব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় ২৮৭টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, ৫ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ পর্যাপ্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২ হাজার ৯৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক এবং ৮৬টি মেডিকেল টিম। ঈদফেরত মানুষের ভোগান্তি : ঈদের ছুটি শেষে এখনো কর্মস্থলে ফিরছে মানুষ। বৈরী আবহাওয়ার কারণে গতকাল পথে পথে ভোগান্তিতে পড়েন তারা। নদী উত্তাল হয়ে ওঠায় গতকাল বিকালে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে বিপাকে পড়েন খুলনা, বাগেরহাট, বরিশালসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঢাকামুখী যাত্রীরা। বৃষ্টির কারণে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটেও ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নদী পাড়ি দেন শত শত মানুষ। চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নগরের দামপাড়া কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফোন নম্বর ০৩১-৬৩০৭৩৯ এবং ০৩১-৬৩৩৬৪৯। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে। চসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা কালাম চৌধুরী বলেন, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সার্বক্ষণিক রেড ক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবক, চসিকের আরবান ভলান্টিয়ার টিম ও কর্মকর্তা-কর্মচারী জরুরি সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। শুকনো খাবার, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানি মজুদ রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্রে জানা যায়, সাইক্লোন প্রস্তুতি প্রকল্প কর্মসূচির আওতায় চট্টগ্রামে প্রায় ১২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও ৫১১টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। মজুদ রাখা হয়েছে প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সজীব কুমার চক্রবর্তী বলেন, আমাদের মূল কর্মসূচি তিনটি- আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, শুকনো খাবার মজুদ রাখা এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা। এসব ব্যাপারে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বাগেরহাটের নদ-নদীর পানি দুই ফুট বৃদ্ধি : ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে বাগেরহাটের পশুর, বলেশ্বর, পানগুছি, দড়াটানা, ভৈরবসহ সব নদ-নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানি দুই ফুট বেড়েছে। তবে, মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ। বৃষ্টির পাশাপাশি উপকূলজুড়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে বইছে দমকা হাওয়া। অশান্ত রয়েছে বঙ্গোপসাগর। সুন্দরবন, শরণখোলা, মোংলা ও বাগেরহাটের প্রধান মৎস্যবন্দর কেবি ফিশারি ঘাটে প্রায় দেড় হাজার ফিশিং ট্রলার ফিরে এসেছে। তবে বন্দর জেটি ও বহির্নোঙরে চারটি বাণিজ্যিক জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা। পটুয়াখালীতে সূর্যের দেখা : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রবিবার ভোর ৫টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২৫৯.৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পটুয়াখালী আবহাওয়া অফিস ও কলাপাড়া রাডার স্টেশন। সোমবারও সারা দিন বৃষ্টিপাত হয়। তবে গতকাল সকাল থেকে পটুয়াখালীতে বৃষ্টি হয়নি। বেশির ভাগ সময়ই আকাশ ছিল পরিষ্কার। সোমবারের টানা বৃষ্টিতে নদ-নদীর পানি এক থেকে দুই ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরারত অধিকাংশ ট্রলার ফিরে এসেছে। কক্সবাজারে দুই-তিন ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত সাগরের পানি : ‘অশনি’র প্রভাবে কক্সবাজারে সাগর উত্তাল রয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে দুই-তিন ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে সাগরের পানি। সৈকতে কমে গেছে পর্যটকের উপস্থিতি। হাল্কা বৃষ্টি ও সতর্ক-সংকেত উপেক্ষা করে সাগরে নামছেন কিছু পর্যটক। তাদের সাগরে নামতে নিরুৎসাহিত করছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ ও লাইফ গার্ড কর্মীরা। সৈকতে দায়িত্বরত সি-সেইফ লাইফ গার্ড জয়নাল আবেদীন বলেন, হাঁটু পানির চেয়ে বেশি দূরে না যেতে হ্যান্ডমাইকে বারবার সতর্ক করা হলেও অনেক পর্যটক তা মানছেন না। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্র। জলাবদ্ধ টঙ্গী : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে গাজীপুরের টঙ্গী। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, বৃষ্টির পানি ড্রেন উপচে সড়কে প্রবাহিত হচ্ছে। টঙ্গী স্টেশন রোড, চেরাগ আলী, কলেজ গেট, আউচপাড়া, দত্তপাড়া, আরিচপুর, গাজীপুরা, টিএন্ডটি, মরকুন, শিলমুনসহ বিভিন্ন এলাকায় জলজট সৃষ্টি হয়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর