বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফাঁসির দুই আসামি ১৩ বছর ধরেই কারাগারে

তুহিন হাওলাদার

বিচারের চূড়ান্ত রায়ে দুই আসামির মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত হলেও দীর্ঘদিনেও তা কার্যকর হয়নি। কনডেম সেলেই তারা কাটিয়ে দিচ্ছেন বছরের পর বছর। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর প্রাণভিক্ষার আবেদনও রাষ্ট্রপতি নাকচ করেছেন এক যুগ আগে। পরে ভিন্ন কৌশলে আসামিদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া লাল কাপড়ে মোড়ানো মৃত্যু পরোয়ানাটি আটকে রাখার সব চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনাটি পুরান ঢাকার স্কুলছাত্র বাপ্পী হত্যা মামলার। ভাগ্যবান আসামিরা হলেন ঢাকার ডেমরার ডগাইর সারুলিয়ার রফিকুল আলমের ছেলে শহিদুল আলম শিপন ও একই এলাকার রবিচন্দ্র সরকারের ছেলে সঞ্জিত সরকার। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

কারাগারসূত্র জানান, দুই আসামি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আছেন। এদের মধ্যে শহিদুল আলম শিপন কাশিমপুর কারাগার-২-এ আর সঞ্জিত সরকার আছেন কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে। আসামিদের স্বজনরা মাঝেমধ্যে দেখা করার জন্য কারাগারে যাতায়াত করেন। এদিকে জানতে চাইলে নিহত বাপ্পীর বোন অ্যাডভোকেট হ্যাপী আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকরের জন্য সব ধরনের চেষ্টা আমরা করেছি। বিভিন্ন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। বিচারিক আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। তবু আদালত থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পৌঁছায়নি।’ এ বিষয়ে ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদা আক্তার বলেন, পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য শিগগিরই মাননীয় আদালতে বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে। জানা গছে, পুরান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি হাই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রুবাইত আহম্মেদ বাপ্পীকে ২০০২ সালের ৬ আগস্ট অপহরণের পর ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন আসামিরা। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ভিকটিমকে আটক করে নারায়ণগঞ্জের চনপাড়ায় রাখা হয়। টাকা না পেয়ে বাপ্পীকে খুন করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় নিহত বাপ্পীর বাবা আলফু মিয়া বাদী হয়ে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর-১৬(৮)০২। পরে এ মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন বিচারক সরকার আবুল মনসুর আহম্মদ। রায়ে পাঁচ আসামি- শহিদুল আলম শিপন, সঞ্জিত সরকার, শংকর রাজবংশী, রিপন কুমার রায় ও শরিফুল ইসলাম বাদলকে (পলাতক) আদালত মৃত্যুদন্ড দেন। নারী ও শিশু মামলা নম্বর ৯৩১/২০০২। রায়ে আসামিদের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দ্রুততার সঙ্গে কার্যকরের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়, যার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ৬৩/০২। পরে আসামিরা এ রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করেন। হাই কোর্ট দুই আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন এবং অন্য তিন আসামির সাজা পরিবর্তন করে কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। পরে আসামিপক্ষ হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে (লিভ টু আপিল নম্বর ৪৬৪/২০০৭)। আপিল বিভাগ লিভ টু অপিল খারিজ করে দেন এবং হাই কোর্টের রায় বহাল রাখেন। এরপর সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রাণভিক্ষার জন্য ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন আসামিরা। সেই আবেদনও নাকচ হয়ে যায়। কিন্তু এখনো ফাঁসি কার্যকর হয়নি। মামলায় অভিযোগ করা হয়, বাদীর ছেলে রুবাইত আহম্মেদ বাপ্পী ২০০২ সালের ৫ আগস্ট প্রতিদিনের মতো বেলা ১১টার দিকে স্কুল থেকে বাসায় আসে। পরে সে নাশতা করে। এরপর বাদীর ভায়রার ছেলে (নিহত বাপ্পীর খালাতো ভাই) শহিদুল আলম শিপন তার বাড়িতে আসেন এবং বাপ্পীর সঙ্গে কথা বলেন। বেলা আনুমানিক ১২টার দিকে বাপ্পীকে খেলার কথা বলে বাসা থেকে নিয়ে যান শিপন। দুপুরে বাপ্পী বাসায় ফিরে না এলে মহল্লায় খোঁজাখুঁজি করা হয়। পরে মহল্লার দুজন ছেলে বাদীর বাসায় এসে জানায়, বাবুবাজার ব্রিজের ঢালে একটি রিকশায় বসা অবস্থায় বাপ্পীকে দেখে জিজ্ঞেস করলে বাপ্পী জানায়, সে একা নয়, তার সঙ্গে খালাতো ভাই শিপনও আছে এবং যাত্রাবাড়ীতে বেড়াতে যাচ্ছে। বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে বাদীর দোকানে টেলিফোন করে ছেলের মুক্তিপণের জন্য ২০ লাখ টাকা দাবি করেন আসামিরা। তারা টাকা যাত্রাবাড়ীর স্টাফ কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এ ছাড়া আরও বলেন যে পুলিশকে খবর দিলে বাদীর ছেলেকে মেরে ফেলবে। পরে বাদী যাত্রাবাড়ীতে বাপ্পীকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে শিপনদের বাড়িতে লোক পাঠান। শিপনদের বাড়িতে খোঁজ করলে তার মা জানান, রিপন, জাহিদ, সঞ্জিত, শিপন, শংকরসহ পাঁচ-ছয় বন্ধু মিলে বেড়াতে গেছে। বাদী তার ছেলেকে না পেয়ে থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশ আসমিদের গ্রেফতার করলে আসামিরা ঘটনার উল্লেখ করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আসামি শহিদুল আলম শিপন ও রিপন কুমার রায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দিতে বলেন, বাপ্পীর গলা আসামি শরীফুল ইসলাম বাদল টিপে ধরে ছিল এবং শংকর পা চেপে ধরে তাকে খুন করে নদীতে ফেলে দেন।

সর্বশেষ খবর