শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
কালশী ট্র্যাজেডি

নয় বছরেও শেষ হয়নি তদন্ত

সাখাওয়াত কাওসার

দীর্ঘ নয় বছরেও শেষ হয়নি রাজধানীর কালশী বিহারি ক্যাম্পে অগ্নিকা-, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় করা হত্যা মামলার তদন্ত। দুষ্কৃতকারীরা চিহ্নিত না হওয়ায় বিহারি ক্যাম্পে বসবাসকারীরা আতঙ্কে ভুগছেন। অন্যদিকে, আগুনে মা-বাবাসহ পরিবারের নয়জনকে হারিয়ে এতিম হয়ে যাওয়া মেয়েটিও অপহরণের ভয়ে ক্যাম্প ছেড়েছেন। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার নেপথ্য কুশীলবরা চিহ্নিত না হওয়ায় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। আবার তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও তদন্ত নিয়ে মুখ খুলছেন না। বারবারই তাদের উত্তর খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হৃদয়স্পর্শী এবং চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনা তদন্তের এমন অবস্থা আমাদের জাতির জন্য অনেক লজ্জাও দুর্ভাগ্যের। আমরা অনেকেই ঘটনার সময় তাক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাই। কিন্তু কেউই লেগে থাকি না। এর সুযোগ নেয় তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। গণতন্ত্র এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই এমনটা বারবার হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর ধারণা, যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে হয়তো তারা খুবই প্রভাবশালী।

এ বিষয়ে উর্দু স্পিকিং ইয়ুথ পিপলস রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্টের দফতর সম্পাদক ইমরান খান বলেন, বিহারি ক্যাম্পের জায়গা দখল করতেই ওই হামলা চালানো হয়। আগুনে পুড়ে ও গুলিতে মারা গেছে বিহারিরা। অথচ মামলায় আসামি করা হয়েছে বিহারিদেরই। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কিছু ভিডিও চিত্র দেওয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি। তবে ঘটনার সময়ে ওই সময় পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ বলেছিল, বিহারিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে আগুনের ঘটনা ঘটে। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী বলেছিলেন, আতশবাজি পোড়ানোকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে বিহারিদের সংঘর্ষ বাধে। এ ছাড়া এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে আগে থেকে বিরোধ ছিল। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় মোট ছয়টি মামলা হয়। মামলা শুরুতে পল্লবী থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরে ডিবি, সিআইডি ও পিবিআই তদন্ত করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর মধ্যে হত্যা মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অন্য আরেকটি মামলায় বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা. মো. বদরুল, সাব্বির, আজাদ, আরজু, আরিফ ও জুয়েলকে এজাহারভুক্ত করে অজ্ঞাত পরিচয় প্রায় ৩ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাটি এখন অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে বলে জানা গেছে। এই মামলাটি এক সময় তদন্ত করেন সিআইডির পরিদর্শক নুরল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মামলাটি বেশ কিছুদিন তদন্ত করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাই। তবে এখন আমি তদন্ত করছি না। আমি সিআইডি থেকে বদলি হয়েছি। মামলাটি এখন অন্য কর্মকর্তা দেখছেন।’ গতকাল তদন্তের সবশেষ অবস্থা জানতে চাইলে ঢাকা ডিভিশনের ডিআইজি মাইনুল হাসান বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের ডিআইজি কুসুম দেওয়ানের বক্তব্যও ছিল একই রকম। সম্প্রতি সরেজমিন ক্যাম্পে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের নানান আক্ষেপের কথা জানা যায়। ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. খুরশিদ আলম বলেন, ‘ক্যাম্পের লোকজন এখনো সেই আগুনের রহস্য জানতে পারেনি।’ তিনি বলেন, পরিকল্পিত ওই আগুনে ইয়াসিনের স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও ছেলের গর্ভবতী স্ত্রী মারা যায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে আছে ইয়াসিনের ছোট মেয়ে ফারজানা। তবে সেও নিরাপদ নয়। ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আগুনে দগ্ধ হয়েও ইয়াসিন কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। পরে সুস্থও হন। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যে রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর রহস্যও এখনো অজানা। ইয়াসিনের মেয়ে ফারজানা বলেন, ‘আমাকেও ওরা মারতে চায়। ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এখন খালার বাসায় থাকছি।’ দীর্ঘ সময়েও এ হত্যায় জড়িতরা শাস্তির আওতায় না আসায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিহারি নেতারা।

 কালশী ট্র্যাজেডির ৯ বছর উপলক্ষে আজ নিহত বিহারিদের স্মরণে আজ ক্যাম্পের ভিতরে মিলাদ মাহফিলের পাশাপাশি মানববন্ধন করে ঘটনার প্রতিবাদ জানাবে বিহারিদের ছাত্র সংগঠন উর্দু স্পিকিংস পিপলস ইয়ুথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট (ইউএসপিওয়াইআরএম)।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পল্লবী থানাধীন ১২ নম্বর সেকশনের ‘ই’ ও ‘ডি’ ব্লকে অবস্থিত আলোচিত কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। ২০১৪ সালে সংঘর্ষ ও আগুনের ঘটনার সময় ওই ক্যাম্পের ৭৭৪ পরিবারের জন্য ছিল মাত্র একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার। যদিও এখন তা বেড়েছে। ক্যাম্পের ঠিক পূর্ব পাশে রাজু বস্তির অবস্থান। ওই বস্তির ঘর তোলার সময় একটি চক্র ৪০০ পরিবারের কাছ থেকে ২০-২৫ হাজার করে টাকা নিয়েছিল। সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয় কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্প থেকে। বিল বাবদ আদায় করা হতো প্রতি মাসে ৬০ টাকা করে। এই আর্থিক লেনদেনের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে স্থানীয় কয়েকটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ঘটনার আগে ১০ জুন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। ক্যাম্পের নেতারা আবার বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এ নিয়ে বিহারি ক্যাম্প ও রাজু বস্তির মধ্যে বিরোধ চলছিল। 

মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-এর পরিদর্শক কবির হোসেন বলেন, তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই ঘটনায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু, এক যুবককে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা, গাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, মারধর, চুরি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও শ্নীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে চারটি মামলা করেন বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা। তবে নিহতদের স্বজনরা কোনো মামলা করেননি। এসব মামলায় ৩২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও অন্তত ৩ হাজার ২২০ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে পাঁচ মামলার এজাহারে বর্ণিত আসামি ও তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে, তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে অভিযোগপত্র। তবে এ ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রে থাকা হত্যা মামলাটির তদন্তে গতি আসেনি।

উর্দুভাষী যুব-ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি ইমরান খান বলেন, নয় বছরেও হত্যা মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় আমরা হতাশ। ২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে কথা বলে বিহারি নেতারা সেসময়ের সংঘর্ষের সময়ের একটি ভিডিও মন্ত্রীকে দেন। তাতে হামলাকারীদের সহজেই চিহ্নিত করা যায় বলে মনে করেন তিনি। সে সময় মন্ত্রী ঘটনাটি তদন্ত করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সেই হত্যাকা-ের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৪ জুন ভোরে পল্লবী কালশীর বিহারি ক্যাম্পে শুরুতে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। পরে পুলিশ আসে। তখন ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ বাধে। এক পর্যায়ে ক্যাম্পের কয়েকটি ঘরে আগুন দেওয়া হয়। সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত হয় একজন। অন্যদিকে আগুনে পুড়ে মারা যান মো. ইয়াসিনসহ তার পরিবারের আটজন। সব মিলে আগুনে পুড়ে ও গুলিবিদ্ধ হয়ে নয়জন মারা যায়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর