মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

গণপরিবহনে অনিরাপদ নারী

♦ যৌন হয়রানির শিকার ৬৫% ♦ বাসে একা চলাচলে থাকে আতঙ্ক-ভয় ♦ কুদৃষ্টির শিকার, শুনতে হয় অশ্লীল মন্তব্য ♦অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে ঝুঁকিতে জীবন

জিন্নাতুন নূর

গণপরিবহনে অনিরাপদ নারী

নারীরা দেশের গণপরিবহনগুলোতে নিরাপদ নন। কর্মজীবী নারী থেকে শুরু করে মেয়েশিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে ওঠামাত্রই নানা ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসযাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর নারীদের একা পেলে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিজেকে বাঁচাতে ভুক্তভোগীদের অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত বাস থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হচ্ছেন। বিভিন্ন জরিপে জানা যায়, নারীরা অনেকটা অস্বস্তি ও আতঙ্ক নিয়েই গণপরিবহনে চলাচল করেন। কারণ গণপরিবহনে চলতে গিয়ে তাদের প্রায়ই অযাচিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। শুনতে হয় অরুচিকর মন্তব্য। শিকার হতে হয় যৌন হয়রানির। এসব ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাসের কিছু পুরুষ যাত্রীসহ চালক ও হেলপাররা জড়িত।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য রোড’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের ৭ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছরে সড়ক-মহাসড়কে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৫৭ জন নারী। এ সময়ে ২৭ জনকে হত্যা করা হয়। গড়ে মাসে পাঁচজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন; নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও ৬৮ জন নারী। নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনের ৬৭ জন ছিলেন বোরকা ও হিজাব পরা এবং ৩২ জন অন্যান্য পোশাক পরিহিত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপরিবহনে নারীদের হয়রানি প্রতিরোধে এর ভিতর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, নারীবান্ধব গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া উচিত।

১৬ জুন ময়মনসিংহের ভালুকায় চলন্ত বাসে এক গার্মেন্টকর্মীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এই অপরাধের অভিযোগে পুলিশ বাসচালকসহ তিনজনকে এরই মধ্যে আটক করেছে। শুক্রবার রাত ১১টার দিকে মাওনা থেকে রিদিশা ফ্যাক্টরির এক গার্মেন্টকর্মী (৩৮) ভালুকার বাসে বাসায় ফিরছিলেন। ভালুকার সিডস্টোর এলাকায় বাসের সব যাত্রী নেমে গেলে একা পেয়ে বাসের চালক ও হেলপার তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে সেই নারী সম্ভ্রম বাঁচাতে বাস থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান। পরে গত রবিবার বেলা ১১টায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভুক্তভোগীর মৃত্যু হয়। এর আগে গত বছর জুলাই মাসে রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর থেকে আজিমপুরগামী বিকাশ পরিবহনের বাসে ওঠেন এক ছাত্রী। সেই ছাত্রী বাসে উঠে চোখ বন্ধ করে এয়ারফোনে গান শুনছিলেন। পরে নীলক্ষেত মোড়ে সব যাত্রী নেমে গেলে তিনি একা হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে সেই ছাত্রীর পাশে বসে তার শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেন বাসের হেলপার। ওই ছাত্রী চিৎকার করলে চালক গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। সিট থেকে উঠে ওই ছাত্রী নামার চেষ্টা করলে হেলপার বাধা দেন। একপর্যায়ে আজিমপুর গার্লস স্কুলের সামনে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন সেই ছাত্রী। এ ছাড়া গত বছর মে মাসে চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় চলন্ত বাসে আরেক তরুণীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করে। এই দুজনই ছিলেন সেই বাসের চালক ও হেলপার। ভুক্তভোগী তরুণীটি পোশাক কারখানার শ্রমিক ছিলেন। বাসের অন্য শ্রমিকরা নেমে গেলে তার ওপর হামলা চালানো হয়। দেশের গণপরিবহনে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের নিয়ম থাকলেও কার্যত এটি মানা হয় না। আবার বাসে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় পড়লেও ভুক্তভোগীর পক্ষে থাকার বদলে অন্য বাসযাত্রীরা তাকে বিষয়টি নিয়ে তর্কে যেতে নিরুৎসাহিত করেন। এমনকি অনেক সময় ভুক্তভোগীকে শুনতে হয় নেতিবাচক মন্তব্যও।

‘ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি : কিশোরী ও তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শিরোনামে আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন ৬৪ দশমিক ৯২ শতাংশ নারী। এসব যৌন হয়রানির মধ্যে আছে- গণপরিবহনে ওঠানামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, নারী যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, তাদের বাজেভাবে স্পর্শ করা, ধাক্কা দেওয়া, তাদের দিকে কুরুচিপূর্ণভাবে তাকানো, চিমটি কাটা, স্পর্শকাতর জায়গায় স্পর্শ করা, গায়ের ওপর ইচ্ছাকৃত ঘুমিয়ে পড়া, কাঁধে হাত দেওয়া এবং অশ্লীল মন্তব্য ও অঙ্গভঙ্গি করা। এ গবেষণায় দেখা যায়, পরিবহনে যৌন নিপীড়কদের মধ্যে বড় একটি অংশই যাত্রী। এরপর বাসের চালক ও হেলপাররাও নারীদের যৌন হয়রানি করেন। ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানান, তারা ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। আর ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ জানান, তারা কিশোর ও যুবক, অর্থাৎ ১৩ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ জানান, বাসে ওঠানামার সময় অসম্মতি থাকার পরও হেলপাররা তাদের স্পর্শ করেন। এতে আরও বলা হয়, গণপরিবহনে হালকা ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কিশোরী ও তরুণীরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২১ দশমিক ২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আর ২৯ দশমিক ৪ শতাংশের মনে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গণপরিবহন। ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ হীনম্মন্যতা এবং ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ বিষণ্ণতায় ভুগছেন। রাজধানীতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কর্মজীবী নারীদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করা হলেও এ সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাসে নারীদের সিট পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকদের। আর পরিবহন যেহেতু সেবা খাত এ জন্য এ খাতে কেউ দুর্ভোগে পড়লে তা দূর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সরকারের কাছে কর্মজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীদের এই দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে অনুরোধ করছি।’

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর