মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে এক খন্ড রাশিয়া

শিমুল মাহমুদ, রূপপুর, পাবনা থেকে ফিরে

বাংলাদেশে এক খন্ড রাশিয়া

সড়কের এক পাশে অনেক নতুন উঁচু ভবন। অন্যপাশে নতুন সুসজ্জিত মার্কেটে বর্ণাঢ্য সাজের দোকানপাট। দোকানের সাজসজ্জা দেখে মনে হতে পারে রাশিয়ার কোনো বিপণিবিতান এটি। দোকানের সাইনবোর্ড, মার্কেটের নাম সবকিছু রাশিয়ান ভাষায় লেখা, বাংলার উপস্থিতি তেমন চোখেই পড়ে না। এসব দোকান ও মার্কেটের মূল ক্রেতা রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বিশাল কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত হাজার হাজার রাশিয়ান নাগরিক। তাদের জন্যই ঈশ্বরদীর রূপপুরে গড়ে উঠেছে এই গ্রিন সিটি। সিটির উল্টোপাশে গড়ে ওঠা মার্কেটের নাম নতুন হাট। সরকারের এই মেগা প্রকল্পে কয়েক হাজার বিদেশি কর্মীর কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক কেন্দ্র বদলে দিয়েছে স্থানীয়দের ভাগ্য। জীবন-জীবিকায় এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এলাকায় জমির দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। স্থানীয়রা নানামুখী পেশায় জড়িয়ে ভাগ্যবদল করছেন। রূপপুরের এই এলাকায় একসময় সন্ধ্যার পরই গাঢ় অন্ধকারে রাতের নিস্তব্ধতা নেমে আসত। সেখানেই এখন আলো ঝলমলে রাত-দিনের কর্মচাঞ্চল্য। প্রায় ৫ সহস্রাধিক রাশিয়ান, বেলারুশ, কাজাখস্তানসহ বিদেশিদের পদচারণে বদলে গেছে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র। চরের বিরানভূমিতে গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী সুদৃশ্য আবাসিক ভবন। রয়েছে ঝকঝকে শপিং মল, বিদেশি আদলের রেস্তোরাঁ ও রিসোর্ট। বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে প্রায় সব বাণিজ্যিক স্থাপনার সাইনবোর্ডই রাশিয়ান হরফে লেখা। উচ্চ শব্দ বাজছে রাশিয়ান জনপ্রিয় গান। মোবাইল ফোনের রিচার্জ বা সার্ভিস সেন্টার, আয়ুর্বেদী ওষুধ কিংবা মুদি দোকান সর্বত্রই রাশিয়ান ভাষার সাইনবোর্ড। প্রতিদিনের কাজের প্রয়োজনে কিছু বাংলা ওরা শিখে নিয়েছে। নিত্য ব্যবহার্য কিছু রাশিয়ান শিখে নিয়েছে স্থানীয় দোকানিরা। রাশিয়ানদের সবার মুখে মুখে ‘বন্ধু’ সম্বোধন। অন্যদিকে গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে নিজেদের কেনাকাটায় প্রয়োজনীয় চাহিদা জানান তারা। প্রোডাক্ট হোম দোকানের স্বত্বাধিকারী তরুণ ইমরান আগে ল্যাপটপের ব্যবসা করতেন। দুই বছর হলো নতুন হাটে সেই দোকানেই ফুড সাপ্লিমেন্টের ব্যবসা শুরু করেছেন। রাশিয়ানদের মধ্যে যারা জিম করেন তাদের মধ্যে ফুড সাপ্লিমেন্টের চাহিদা বেশি। রাশিয়া, চীন, জার্মানি থেকে আনা ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি করেন তিনি। বললেন, ব্যবসা ভালোই চলছে। নতুন হাটে ছোট-বড় সব ধরনের দোকান মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আয়ুর্বেদ দাওয়াখানার হাকিম জানালেন, রাশিয়ানদের একটা বড় অংশ হার্বাল-আয়ুর্বেদ ওষুধের ওপর নির্ভর করেন। তারা নির্দিষ্ট ওষুধ চেয়ে নেন। একবার নেওয়ার পর বার বার আসেন। তিনি বলেন, অনেকে চুক্তির মেয়াদ শেষে কিংবা ছুটিতে দেশে যাওয়ার সময় ব্যাগ ভরে ওষুধ ও কাপড় নিয়ে যান। আশপাশের রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টের বাইরে শুধু নতুন হাটেই কয়েকটি বার, পারলার, অনেক ফুলের দোকানসহ রাশিয়ানদের চাহিদাভিত্তিক খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। এক সময়ের বিরানভূমিতে গড়ে ওঠা আবাসিক স্থাপনা, মার্কেট, শপিং মল দেখলে রাশিয়ার আধুনিক শহর ভেবে ভুল হতে পারে। বিদেশি সংস্কৃতির ছোঁয়াও লেগেছে স্থানীয়দের জীবনে। ফল ও সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাশিয়ার নাগরিকদের সঙ্গে কেনাবেচা করতে করতে বাঙালিরা অনেকেই শিখেছেন রাশান ভাষা। সব মিলিয়ে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ছোঁয়ায় বদলে গেছে ঈশ্বরদীর প্রত্যন্ত গ্রাম রূপপুর। প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ শুরুর পর থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে কয়েক হাজার বেকার যুবকের।

এখানে বিদেশিদের জন্য নির্মিত গ্রিনসিটির ২০ তলা বিশিষ্ট ২০টি ভবনে থাকছেন প্রকল্পের বিদেশি কর্মীরা। গ্রিনসিটির বাইরে চারপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রিসোর্ট, বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। আগের চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য এখন অনেক ভালো হচ্ছে। রাশিয়ানদের কাছে ফুলের কদর বেশি। সেই চাহিদার কারণেই কয়েকটি ফুলের দোকান গড়ে উঠেছে নতুন হাটে। দামও বেশ চড়া। ছোট্ট একটি ফুলের তোড়া বিক্রি হয় হাজার টাকা দামে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন স্থাপনায় রুশ সংস্কৃতির ছোঁয়া। রেস্তোরাঁর নাম রাখা হয়েছে রুশ ডাইন, রুশ ফ্যাশন।

রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রকল্পে দেশি-বিদেশি ২৫ হাজার প্রকৌশলী ও শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের মধ্যে রাশিয়া, বেলারুশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫ সহস্রাধিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক রয়েছেন।

 

সর্বশেষ খবর