সোমবার, ১৭ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুদ্রাবাজারে নজরদারি চায় আইএমএফ

দেশি-বিদেশি মুদ্রাবাজারের হালনাগাদ তথ্য ও সামষ্টিক অর্থনীতির মূল্যায়ন জানাতে হবে প্রত্যেক প্রান্তিকে

মানিক মুনতাসির

মুদ্রাবাজারে নজরদারি চায় আইএমএফ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করছে, ডলার সংকট কাটাতে হলে এ বাজারকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে দিতে হবে। অথচ নিকট অতীতে বাংলাদেশ তা করেনি। বরং কৃত্রিমভাবে ডলারের দর কমিয়ে রাখা হয়েছিল। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে সংকট তৈরি হয়। আমদানিতে নিয়ন্ত্রণারোপ করেও ডলার সংকট কাটেনি। ফলে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়ন ঘটে। এতে মূলস্ফীতির চাপও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যার একটা প্রকট ধাক্কা লেগেছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর। এতে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রকৃত চিত্রকে রাখা হয়েছিল তাদের দৃষ্টির বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষদিকে সংকট সামলে আনতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি করে বাংলাদেশ ও আইএমএফ। যার প্রথম কিস্তি গত ফেব্রুয়ারিতে ছাড় করা হয়। এখন দ্বিতীয় কিস্তির আলোচনা শুরুর অপেক্ষা করছে উভয় পক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের একটি যৌথ কারিগরি মিশন বাংলাদেশ সফর করছে। প্রতিনিধি দলটি আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবে। এরই মধ্যে সংস্থাটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বো লি এক ঝটিকা সফরে ঢাকা এসেছেন। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করছে আইএমএফের কারিগরি দল। সেসব বৈঠকে এসব আলোচনা উঠে এসেছে। সংস্থাটি দেশের আর্থিক বাজার ব্যবস্থায় নজরদারি বাড়াতে চায়। একই সঙ্গে এখন থেকে দেশি-বিদেশি মুদ্রাবাজারের হালনাগাদ তথ্য ও সামষ্টিক অর্থনীতির মূল্যায়ন তাদের জানাতে হবে। অর্থবিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আইএমএফ মনে করে, দীর্ঘায়িত ডলার সংকট কমানোর কোনো উদ্যোগই কাজে আসেনি। ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরে ডলারের একক রেট এখনো চালু হয়নি। ফলে ডলারের বাজারে অস্থিরতা এখনো কাটেনি। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সংকট নিয়ন্ত্রণে আনতে ভারতীয় রুপির মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির এলসি খোলার কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। চীনা মুদ্রায়ও আমদানি-রপ্তানির আলোচনা চলমান। এ ছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একক কোনো মুদ্রার প্রচলন করা যায় কি না- সে আলোচনা উঠে আসছে নতুন করে।

এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বড় ধকল মোকাবিলা করছে। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির বিপরীতে দেওয়া শর্ত মোতাবেক বেশকিছু সংস্কারে হাত দিয়েছে সরকার। আর্থিক বাজার কাঠামো বিশেষ করে শেয়ারবাজার, বন্ড মার্কেট ও মুদ্রাবাজার ব্যবস্থায় কাঠামোতেও কিছু সংস্কার আনার পরামর্শ রয়েছে। সেগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তা নিবিড়ভাবে নজরদারি করতে চায় দাতা সংস্থাটি।

জানা গেছে, আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচির কারণে ইতোমধ্যে দেশের মানুষের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া ভর্তুকি কমানো এবং কিছু ক্ষেত্রে তুলে দেওয়া হয়েছে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে গিয়ে মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। মুদ্রানীতিতে নমনীয় করে সুদহারও বাড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে আইএমএফের পরামর্শে মুদ্রানীতিতে নীতি সুদ হারের করিডোর প্রথা, সুদহারের সীমা প্রত্যাহার, ডলারের একক দাম, রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এদিকে আইএমএফের শর্ত মেনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংস্থাটির সুপারিশ করা পদ্ধতি অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ বর্তমানে ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত রিজার্ভ বা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হিসাব করতে ৬৪০ কোটি ডলার বাদ দিয়েছে।

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে বারবার চাপ দিয়ে আসছে আইএমএফ। যদিও তা কমেনি, বরং বেড়েছে। তারা খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের পরিচালকদের ক্ষমতার অপব্যহার কমাতে আইনের সংস্কার চায় আইএমএফ। এ ছাড়া ব্যাংকের পাশাপাশি বীমা কোম্পানি, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ডাটাভিত্তিক হালনাগাদ তথ্য, পরিদর্শন প্রতিবেদন এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে সংস্থাটি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, বাকি ৪২২ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার ৬টি কিস্তিতে ছাড় করবে। ছয় মাস পর পর কিস্তি পাওয়া যাবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো ঋণ পাওয়া যাবে।

সর্বশেষ খবর