রবিবার, ৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন কতদূর

জয়শ্রী ভাদুড়ী

এ বছর মৌসুমের শুরুতেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যু ঠেকাতে এর ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা চলছে। দেশে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন প্রয়োগের ব্যাপারে মতামত দিচ্ছেন ভাইরোলজিস্টরা। সরকারও ভ্যাকসিন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে, সেখানে কার্যকর ফল পাওয়া গেলে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলেই বাংলাদেশে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। আপনারা জানেন, একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কিছু দেশে এটি অনুমোদন পেয়েছে। সেই দেশগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে, সাধারণত ডব্লিউএইচও যখন অনুমোদন দেয়, তার পরে আমরা শুরু করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর টিকার কার্যকারিতা নিয়ে নানা মহলে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলছে। সে হিসেবে এটা যদি সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশের জন্য কার্যকর হয়, সেই বিষয়টা মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিবেচনাধীন আছে। ডব্লিউএইচওর (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) সঙ্গে এ বিষয়ে আমাদের যোগাযোগ আছে।’ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গুর কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদহানি হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এর বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ব্যবহারের দিকেই যেতে হবে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের মধ্যে কিউডেঙ্গা আমাদের সঠিক নির্বাচন হতে পারে। তবে তার আগে কিউডেঙ্গার ব্যবহারজনিত ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। ডেঙ্গুর গণটিকাদান কর্মসূচি গ্রহণের আগে বাংলাদেশে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনের বিজ্ঞানসম্মত ট্রায়াল হতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্য যে বা যেসব টিকা আবিষ্কারের পথে রয়েছে তার খোঁজখবর রাখতে হবে। সবকিছু মিলে আগামী বছর ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই আমরা ডেঙ্গু ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারি।’ যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর সানোফি এবং লুই পাস্তুর ইনস্টিটিউট মিলে ডেংভাক্সিয়া নামে একটি টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়। ফিলিপিন্স, পুয়ের্তো রিকোসহ কয়েকটি দেশে এ টিকার প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) পরামর্শ দিয়েছে, নয় থেকে ১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে যারা এর আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, শুধু তাদের এ টিকা দেওয়া যাবে। এর বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এ টিকার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়নি। তবে সিঙ্গাপুরে এ টিকা ১২ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত শুধু ডেংভাক্সিয়া টিকা অনুমোদন পেয়েছে। ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে অন্য পাঁচটি টিকা এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে জাপানের তাকিদা কোম্পানির কিউডেঙ্গা এবং ব্রাজিলের ইনস্টিটিউট বুটানটান আর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের যৌথ উদ্যোগের টিকা বুটানটান-ডিভি। তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় বিভিন্ন দেশে অনেক মানুষকে টিকা দিয়ে কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। সেখানে সফলতা এলে এবং নিরাপদ বলে প্রমাণিত হলে সেসব টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমানে ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় ১১টি দেশে এসব টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, কিউডেঙ্গা টিকাটি ডেঙ্গুর চার ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর বলে দেখা গেছে। ইন্দোনেশিয়ায় এটা ব্যাপক ভিত্তিতে দেওয়া শুরু হয়েছে। সেখানে এটির দুই ডোজের খরচ পড়ে ৮০ ডলার। ‘ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে, জনসচেতনতা ও মশক নিধনের পাশাপাশি এ রোগের বিস্তার রোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ও বিশ্বব্যাপী এর প্রয়োগ সম্পর্কে ভাবতে হবে। বর্তমানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত দুটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন আছে যেগুলো ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় ২০টির মতো দেশে অনুমোদন পেয়েছে। বাংলাদেশে এ ভ্যাকসিনগুলোর প্রয়োগের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসতে হবে।’ ডেঙ্গু সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। গতকাল বিএসএমএমইউ মিলনায়তনে ডেঙ্গুবিরোধী সামাজিক আন্দোলন চাই বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় উপাচার্য এ কথা বলেন। উপাচার্য বলেন, ‘বিএসএমএমইউতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের বিষয়ে গবেষণা করে তৈরির ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নেব।’ এ সময় টিকা তৈরির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগকে দ্রুত কাজ শুরু করার নির্দেশনা দেন অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সারা বছর ডেঙ্গু নিয়ে কাজ হয় না বলেই আজ এ অবস্থা। স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে যে কোনো কাজ, গবেষণা করার জন্য উৎকৃষ্ট স্থান হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে আমরা ডেঙ্গু রিসার্চ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলব। ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরাও কাজ করবেন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর