শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

কারা হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে নানা অভিযোগ

♦ তদন্ত কমিটি নিয়েও প্রশ্ন ♦ কারাবিধি সংশোধনের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা

সাখাওয়াত কাওসার

কারা হেফাজতে বন্দির মৃত্যু নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। এসব মৃত্যুকে কারা কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক মৃত্যু দাবি করলেও মাঝেমাঝেই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে গঠিত তদন্ত কমিটির নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা নিয়েও নানা সন্দেহের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কারা কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ না থাকার কারণে অজানাই থেকে যাচ্ছে মৃত্যুর সঠিক কারণ।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান কারা বিধিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যা কারা কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়নি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারের নানা অনিয়মের বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। অন্যদিকে, কোনো অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত করতে হলে নিজস্ব লোক দিয়েই করার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আছে কারা অধিদফতরের। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট কারাগারের কর্মকর্তাদের দিয়েই তারা তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

এ ব্যাপারে কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারা বিধিতে কারাগারের বাইরে থেকে কোনো বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নেই। তবে বিধি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা আমরা সব সময়ই নিয়ে থাকি।

কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ জন মারা গেছেন। কারা হাসপাতালের বাইরে ভর্তি অবস্থায় ১৫৩ জন মারা যান। ২০২২ সালে কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৯৫ জন বন্দি। কারাগারের বাইরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ২১২ জন। আত্মহত্যা করেছেন তিনজন। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, নিজেদের লোক দিয়ে তদন্ত করানো হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকৃত ঘটনা উঠে আসে না। এসব মৃত্যুর একটি নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য বহু দিন ধরে আমরা বলে আসছি। সেই কমিটিতে প্রয়োজন হলে বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্র্ভুক্ত করা উচিত। সেই মান্দাতার আমলের কারাবিধির সংশোধন সময়ের দাবি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালের ৭ জুন হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি গোলাম মোস্তফার মৃত্যু নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে এক বছর পর ময়নাতদন্তে উঠে আসে, মোস্তফাকে শ্বাসরোধে খুন করা হয়েছে। গত ৭ জুলাই অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে গাজীপুর সদর থানায় মামলা করেন এসআই ফরিদ আহাম্মদ। গত ৮ জুলাই কাশিমপুর কারাগারের হাই সিকিউরিটি-৪ এর হিমেল বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় আমিরুল ইসলাম প্রকাশ ওরফে রাশেদ উদ্দীন (৩৪) নামে এক কয়েদির মৃত্যু হয়। তিনি নোয়াখালীর হাতিয়া মধ্য চেঙ্গা এলাকার নুরুল ইসলাম চৌকিদারের ছেলে। মোস্তফার মতোই প্রাথমিকভাবে তার মৃত্যুর ঘটনাকে আত্মহত্যা বলছে কারা কর্তৃপক্ষ। একাধিক সূত্র বলছে, ঘটনার দুই দিন আগে রাশেদকে জমাদার নজরুল ও জাকির শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। নেপথ্যে ছিলেন ডেপুটি জেলার রেজাউল হক। সূত্র আরও বলছে, রেজাউলের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটটি বন্দিদের কাছ থেকে নানা উসিলায় অর্থ আদায় করেন। প্রতিবাদ করলেই তাদের ওপর চলে নির্যাতন। ওই ঘটনার পর নজরুলকে আইপি গেটে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং জাকির ছুটিতে চলে যান। গত ১৯ জুলাই নওগাঁ জেলা কারাগারে মো. নূর ইসলাম নামে এক হাজতির মৃত্যু হয়। তিনি সদর উপজেলার মাঝিপাড়া গ্রামের মো. জান বক্সের ছেলে। নূর ইসলামের স্ত্রী রূপালী বেগমের অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে আসার পর তার স্বামীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালো দাগ ও ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। তার স্বামীকে জেলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।

তবে কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছিল, অতিরিক্ত নেশার জন্য ছোটাছুটি করার সময় দৌড় দিতে গিয়ে গ্রিলের দরজায় ধাক্কা লেগে মাথায় সামান্য আঘাত পাওয়ায় দাগ হয়েছিল। তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি।

চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নজরুল ইসলাম নামে এক কয়েদির মৃত্যু নিয়ে নানা আলোচনার জন্ম দেয়। কারা কর্তৃপক্ষের দাবি ওইদিন সকালে সেলের ফ্যানের সঙ্গে গলায় গামছা বেঁধে তিনি আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে এক কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই কারাগারের জেলার লুৎফর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া নানা অভিযোগের বিষয়ে সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা বলেন, এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। তাদের দেওয়া বক্তব্যের সবকিছুই আমলে নেওয়া ঠিক হবে না।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কারাগারে ৩৮৫ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ১৪৯ ও আটক ২৩৬ জন।

আরও মৃত্যু ঘিরে রহস্য : গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফজর আলী ও ৩০ আগস্ট খোকা মিয়া নামের দুই বন্দি নরসিংদী কারাগারে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করেন। এই দুটি ঘটনাতেও দায়িত্ব অবহেলায় নিম্ন পদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। গত বছরের ১৩ মার্চে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি জহিরুল মারা গেলে কারা কর্তৃপক্ষ অসুস্থতার কথা বলে। তবে মৃতের বড় ভাই আলী আকবর দাবি করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন জহিরুলকে গ্রেফতারের পর আদালতে হাজির না করে ব্যাপক মারধর করলে কারাগারে মারা যান তিনি। মৃত্যুর অন্তত পাঁচ দিন আগে কারাগারের মধ্যে কিছু লোক জোড় করে তার ঘাড়ে ইনজেকশন দেয় বলেও দাবি করেন তিনি। ২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে আইনজীবী পলাশ কুমার রায় আগুনে পুড়ে মারা গেলে কারা কর্তৃপক্ষ আত্মহত্যা বলে জানালেও ওই সময় তার পরিবার আত্মহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন।

কারা মৃত্যু নিয়ে নানা অভিযোগের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, চরম পর্যায়ের অরাজকতা চলছে দেশের কারাগারগুলোতে। বিদ্যমান কারাবিধির পরিবর্তন অর্থাৎ যুগপোযুগী করা এখন সময়ের দাবি। তিনি আরও বলেন, কারাগারের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই নাজুক।

 

সর্বশেষ খবর