রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

রহস্য ৬৩৩ কোটি টাকা লেনদেনে

মোবাইল ফোন রিচার্জের এক মালিকের দুই দোকানে বিপুল অর্থ দেনদেন নেপথ্যে হুন্ডি

মাহবুব মমতাজী

রহস্য ৬৩৩ কোটি টাকা লেনদেনে

মেসার্স আলমগীর এক্সপ্রেস ও নাসুয়া এক্সপ্রেস। একই মালিকের দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা মূলত মোবাইল রিচার্জের অর্থাৎ ফ্ল্যাক্সিলোডের। গত এক বছরে এই দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬৩৩ কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। বিষয়টি নজরে আসে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)। মোবাইল রিচার্জের আড়ালে এই প্রতিষ্ঠানে হুন্ডি ব্যবসার অভিযোগটি প্রথমে চিহ্নিত করে বিএফআইইউ। এরপর সংস্থাটি এ নিয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) অবহিত করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেসার্স আলমগীর এক্সপ্রেস নামের দোকানটি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়া বাজারের ওবায়েদ উল্লাহ সুপার মার্কেটে। এর ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া ২ নম্বর উজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। মালিক কুতুব উদ্দিন শাওন। একই মালিকের কুমিল্লা সিটি করপোরেশন থেকে আরেকটি মোবাইল রিচার্জের দোকানের ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে। নাম নাসুয়া এক্সপ্রেস। ট্রেড লাইসেন্স কুমিল্লা এলাকায় নেওয়া হলেও ওই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছে রাজধানীর গুলশান ও বনানী এলাকা থেকে। কুতুব উদ্দিন শাওনের দুই দোকানে এক বছরে প্রায় ৬৩৩ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে বিএফআইইউ এবং সিআইডির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মেসার্স আলমগীর এক্সপ্রেস নামে কুমিল্লার মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে গত এক বছরে ৮১ কোটি ৬১ লাখ টাকা জমা করা হয়েছে। এর মধ্যে অনলাইনে গুলশান থেকে ১৫ লাখ টাকা জমা হয়েছে ওই অ্যাকাউন্টে।

একই শাখায় নাসুয়া এক্সপ্রেস নামে থাকা অ্যাকাউন্টে গত এক বছরে জমা হয়েছে ৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় হলেও বনানী এলাকা থেকে অনলাইনে ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করা হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। এসব টাকার মধ্যে কুমিল্লা ইসলামী ব্যাংকের শাখায় মেসার্স গাজী আইটি নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে নাসুয়া এক্সপ্রেস নামের অ্যাকাউন্টে ৫৯ লাখ টাকা জমা করা হয়। দুই অ্যাকাউন্টধারীর ব্যবসার সঙ্গে মিল বা সামঞ্জস্যতা না পাওয়ায় অস্বাভাবিকতার সন্দেহ খুঁজে পায় বিএফআইইউ। লেনদেনসমূহের সঙ্গে গ্রাহকের ব্যবসার মিল না পাওয়ায় অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে বিএফআইইউ এর সন্দেহের কথা সিআইডিকে অবহিত করে। সিআইডি সূত্র জানায়, কুমিল্লায় ইস্টার্ন ব্যাংকের এসএমই শাখায় মেসার্স আলমগীর এক্সপ্রেস নামে আরেক অ্যাকাউন্ট আছে। এখানেও ৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা জমা হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বরের তথ্যানুযায়ী- কুমিল্লা এলাকার ১ হাজার ৯০৬টি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ডিস্টিবিউটরের তালিকা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৮২টি বন্ধ। ১ হাজার ২২৪টির মধ্যে ২৭টি এজেন্ট অবৈধ হুন্ডির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এই এজেন্টগুলোর মধ্যে মেসার্স মিয়াজী টেলিকম, ভাই ভাই টেলিকম, কবির টেলিকম, হাজারী বুকস অ্যান্ড স্টেশনারি মার্ট টেলিকম এবং বিসমিল্লাহ টেলিকমের মাধ্যমে বড় অঙ্কের লেনদেন হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এসবের মধ্যেও অবৈধ হুন্ডির সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ করা হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হুন্ডি ব্যবহার অভিযোগ আলমগীর এক্সপ্রেসের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আলমগীর এক্সপ্রেসের নামে থাকা অ্যাকান্ট চারটি এবং নাসুয়া এক্সপ্রেস নামে আছে দুটি অ্যাকাউন্ট। ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে গত বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত ওইসব অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬৩৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা জমা এবং সমপরিমাণ টাকা তুলে নেওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে। সিআইডি বলছে, সারা দেশে এমন মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা দুই হাজারের বেশি তারা চিহ্নিত করেছে। এ ছাড়া যেসব ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে তাদের প্রায় শতাধিক ফাইল বিএফআইইউ থেকে সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। এসব ফাইলের সূত্র ধরে সংস্থাটি ফরিদপুর, মাদারীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদীর বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এদের সন্তানদের কেউ লেবাননে ব্যবসা করে, কেউ সৌদি আরবে থাকে, কেউ দুবাইতে, আবার কেউ বাহরাইনে থাকে।

এ বিষয়ে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, এমএফএস সার্ভিসে হুন্ডির সঙ্গে জড়িতদের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিট কাজ করছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য নিতে হবে।

যাদেরকে সিআইডিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাদের ভাষ্য হলো তাদের কাছে যখন দেশের বাইরে থেকে কেউ টাকা পাঠায় তখন মোবাইলে ফোন দিয়ে শুধু জানায় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হবে। কী পরিমাণ টাকা পাঠানো হবে ওইটা জানিয়ে দেয়। পরে ব্যাংক থেকে এসএমএস চলে আসে। কিন্তু কে, কীভাবে টাকাটা দেয় তা তারা বলতে পারবে না। সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে হুন্ডি কিংবা টাকা পাচার প্রতিরোধে আমাদের দুটি ইউনিট কাজ করছে। এর মধ্যে আছে ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট এবং সাইবার ক্রাইম মনিটরিং ইউনিট। সিআইডির সাইবার ক্রাইম মনিটরিং ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, আমরা অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে প্রথমে ৫ হাজার নম্বর পেয়েছিলাম। পরে যেগুলোতে কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করি। এসব নম্বরে লেনদেন হয়েছে বেশির ভাগই রাত ২টার পরে। কুমিল্লা ছাড়াও আমরা হুন্ডি চক্রের ১১ জনকে চট্টগ্রাম থেকে আটক করা হয়েছিল বলে তিনি জানান।

সর্বশেষ খবর