সোমবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

সক্রিয় নেটওয়ার্ক বিপন্ন বন্যপ্রাণী

জরিপ প্রতিবেদন

জিন্নাতুন নূর

সক্রিয় নেটওয়ার্ক বিপন্ন বন্যপ্রাণী

দেশজুড়ে বেশ সক্রিয় বন্যপ্রাণী বেচাকেনার নেটওয়ার্ক। বন্যপ্রাণী ব্যবসায়ীরা বেচাকেনা করছেন- বাঘ, কুমির, কচ্ছপ ও হরিণসহ বেশ কিছু বিপন্ন প্রাণী। এর মধ্যে বাঘ ও কুমিরের মতো প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ওষুধের উপকরণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। আর বন্য শূকর ও হরিণ জাতীয় প্রাণীর মাংস স্থানীয় বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে খাদ্য হিসেবে। এশীয় দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও মিয়ানমারে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী। দেশের ভিতরে পাহাড়ি এলাকা, জেলা শহরের নিকটবর্তী বন এলাকা এবং রাজধানীর বাজারে দেশি প্রজাতি ছাড়াও দেশের বাইরের বন্যপ্রাণী বিক্রি হয়। গ্রীষ্মকালের চেয়ে বর্ষা ও শীতকালে তুলনামূলক বেশি বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এক্সপ্লোরিং মার্কেট বেইজড ওয়াইল্ড ট্রেড ডায়নামিকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

এই প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে দেশের ১৩টি বন্যপ্রাণী বাজারের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের কবুতর, হরিণ, টিয়া পাখি ও কচ্ছপ বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়াও বাঘ ও কুমিরও এই তালিকায় আছে। এতে বলা হয়, গ্রামের ৪৮ শতাংশ মানুষ ট্র্যাডিশনাল যে ওষুধ ব্যবহার করেন তার বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে তৈরি করা হয়। সরাসরি বাজার থেকে, ডার্কওয়েব বা অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী বাজারজাত করা হয়। বন্যপ্রাণী বেচাকেনার জন্য দেশে তিন ধরনের বাজার রয়েছে-পাহাড়ি, মফস্বল বা জেলা শহর এবং শহুরে বা রাজধানীর বাজার। পাহাড়ি এলাকার মধ্যে আলীকদম, স্বনির্ভর বাজার ও বনরূপা বাজারে বন্যপ্রাণী বিক্রি হয়। জেলা পর্যায়ে আছে পাথরঘাটা, খালিশপুর, ফুলতোলা এবং ভৈরব। আর রাজধানীর মধ্যে টঙ্গী বাজার, মিরপুর-১, শাঁখারীবাজার, মেরাদিয়া বাজার, কাপ্তানবাজার এবং চট্টগ্রামে বন্যপ্রাণীর বাজার আছে। এই জরিপের জন্য দেশের ৩৩৭ জন বন্যপ্রাণী ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলা হয়। জানা যায়, এক বছরে মোট ৯২৮টি বন্যপ্রাণী বিক্রি হয় ১৩টি বাজারে। সাধারণত জীবন্ত প্রাণী, ক্ষেত্রবিশেষে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে দাম বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণীর। বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দাম সর্বনিম্ন ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। কুমিরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দাম সর্বনিম্ন ৮২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা। পাখির মধ্যে কাকাতুয়ার দাম সর্বনিম্ন সাড়ে আট হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা। বেশির ভাগ পাখি পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রি হয়। আর স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো সাধারণত মাংস হিসেবে ব্যবহার ও ওষুধের কাজে মৃত প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। ছোট কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী জীবন্ত বিক্রি হয়। তবে হরিণের মতো প্রাণী মাংস হিসেবে বিক্রি হয়। সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীগুলো জীবন্ত বিক্রি হয় তবে কিছু সরীসৃপের মাংস ও দেহের অংশ বিশেষ ওষুধ হিসেবে বিক্রি হয়। এর মধ্যে বিষধর সাপও আছে।  জানা যায়, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালের চেয়ে বর্ষা ও শীতকালে বেশি বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হয়। বর্ষা মৌসুমে গ্রামাঞ্চলে কাজ কম থাকায় অনেকে বন্যপ্রাণী শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দেখা যায় পাহাড়ি বাজারে ৪৭ শতাংশ বিপন্নপ্রায় প্রাণী বিক্রি হচ্ছে। আর জেলা পর্যায়ে ২৬ শতাংশ এবং শহরে ২৭ শতাংশ বিপন্নপ্রায় প্রাণী বিক্রি হয়। ৫১ শতাংশ বিপন্ন প্রাণীর চামড়া, হাড় ও দাঁত বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে বিক্রি হয়। প্রতিবেদনটি বলছে, বন্যপ্রাণীর মূল বেচাকেনার এক-তৃতীয়াংশ চট্টগ্রামেই হয়। এর কিছু দেশের বাইরে এবং কিছু ঢাকায় বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। আর ঢাকা হচ্ছে বন্যপ্রাণী  বেচাকেনার প্রধান স্থান। এ ছাড়াও দেশের মধ্যে খুলনাও এসব প্রাণী বেচাকেনার অন্যতম স্পট।

পাখি শিকারিদের তেমন শাস্তি পেতে দেখা যায় না বলে বন্যপ্রাণীর মধ্যে পাখি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। আবার গুরুত্ব কম থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও বন্যপ্রাণী বেচাকেনার বিষয়টিতে নজরদারি কম দেন। ছোট হওয়ায় দেশজুড়ে পাখির বেচাকেনাও বেশি। ব্যবসায়ীরা দৃষ্টি এড়াতে কবুতরের খাঁচায় অনেক সময় অন্য বন্যপ্রাণী পরিবহন করেন। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে পড়ে না। বাজারে পোষা পাখি ও খাবার হিসেবে চাহিদা থাকায় বন্যপ্রাণীর ব্যবসায়ীরা পাখি বেচাকেনাকে নিরাপদ মনে করেন। মানবকণ্ঠ নকল করতে পারদর্শী হওয়ায় পোষাপাখি হিসেবে পাহাড়ি ময়নার চাহিদা বেশি। আর পোষাপাখি হিসেবে প্যারোট ও ম্যাকাউর চাহিদা বিশ্বব্যাপী। শহরের ক্রেতাদের অনেকেই অনলাইন প্ল্যাটফরম থেকে পোষাপাখি কেনেন।

আর সুন্দরবনের আশপাশের ব্যবসায়ীরা সাধারণত বাঘ ও কুমিরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, হরিণের মাংস ও চামড়া বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত। জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা বাড়ছে। এ জন্য সুন্দরবনের আশপাশের জেলায় বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ হরিণের মাংস বিক্রির ঘটনা ঘটছে।

খাদ্য হিসেবে পাহাড়ি এলাকা বা পার্বত্য চট্টগ্রামে স্তন্যপায়ী প্রাণীর চাহিদা বেশি। এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এসব প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকেন। পাহাড়ি বাজারে বিক্রি হওয়া ৪৭ শতাংশই বিপন্নপ্রায় প্রাণী। এর মধ্যে বন্য শূকর ও হরিণের মাংস পাহাড়ি বাজারে বেশি বিক্রি হয়। সাধারণত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, চিতাবাঘের মতো প্রাণী বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে বিক্রি হয়। এই প্রাণীগুলোর তেল, মাংস, চামড়া শহরের অনেক বাজারে গোপনে বিক্রি হয়ে থাকে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ২০ জন ব্যবসায়ী জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়ার ভয়ে এ ধরনের প্রাণীগুলো জীবন্ত অবস্থায় বাজার বা বাড়িতে রাখা বিপজ্জনক। স্থানীয়রা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করায় এসব প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্যপ্রাণী বেচাকেনা ও পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা যেসব জেলায় আছেন তাদের তালিকা তৈরি করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট তা ইন্টারপোলকে জানিয়ে দেয়। সেই তালিকা ইন্টারপোল বাংলাদেশ পুলিশকে পৌঁছে দেয়। দেশে যারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা বেশিরভাগই ‘সাপোর্টিং বিজনেস’ হিসেবে এটি করেন।

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অনেক বন্যপ্রাণী বৈধভাবে রপ্তানি করা হয়। তবে বৈধভাবে পাঠানো এসব প্রাণীর সঙ্গে অবৈধভাবে কোনো প্রাণী পাচার হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্ন। সাধারণত গভীর রাতে বিমানবন্দরে এসব প্রাণীর ওঠানামার সুযোগ কাজে লাগায় প্রাণী বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত সিন্ডিকেট। তিনি জানান, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটটি বন বিভাগের আওতায় অনেকটা যৌথবাহিনীর মতো কাজ করছে। বিভিন্ন ইউনিট থেকে জনবল নিয়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর