শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফের মাথা চাড়া এমএলএম প্রতারণা

♦ টার্গেট মফস্বলের সাধারণ মানুষ ♦ খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, খাগড়াছড়ির আট কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ♦ জড়িয়ে পড়ছে এনজিও বীমা কোম্পানিও ♦ লাইসেন্স ছাড়াই চলছে সঞ্চয় ও ঋণদান কার্যক্রম ♦ গোয়েন্দা প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ফের মাথা চাড়া এমএলএম প্রতারণা

গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির নামে নতুন করে নিবন্ধন দেওয়া না হলেও গোপনে গোপনে বেশ কয়েকটি কোম্পানি প্রতারণামূলক এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতে এরা বদল করেছে টার্গেট। রাজধানীতে কার্যক্রম না চালিয়ে একটি নির্দিষ্ট বিভাগ বা জেলার সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে নীরবে নিভৃতে অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। জাতীয়ভাবে কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে সক্ষম হচ্ছে অভিযুক্ত কোম্পানিগুলো।

সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের বেশ কয়েকটি কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। এসব কোম্পানির অনিয়ম তুলে ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমএলএম আইন ২০১৩ এবং সমবায় সমিতি আইন ২০০১-এর বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে কয়েকটি কোম্পানি। এসব কোম্পানি বন্ধ করতে না পারলে সাধারণ মানুষ পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হতে পারে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

অভিযুক্ত কোম্পানিগুলো মূলত মফস্বলের সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে নীরবে প্রতারণার জাল বিছিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের না আছে কোনো লাইসেন্স না কোনো নিবন্ধন। সারা দেশে এ ধরনের ১০টি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা, যার মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠানই জালিয়াতিতে সম্পৃক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে নানা অনিয়ম দেখা গেছে। খুলনার পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটি, কুষ্টিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি, সাতক্ষীরার দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটি, খাগড়াছড়ির একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি কোম্পানির অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নামে-বেনামে গজিয়ে ওঠা কোম্পানি ছাড়াও বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এমন কি বীমা কোম্পানিও এমএলএম-এর নামে অবৈধ ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে- যা উদ্বেগজনক। কিছু এনজিও তাদের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নগদে বা কিস্তিতে গ্রাহকদের ইলেকট্রনিক্স পণ্য নিতে বাধ্য করছে। এনজিওগুলোর এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধে সম্প্রতি মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সার্কুলার জারি করেছে। তবে কোন কোন প্রতিষ্ঠান এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত তার নাম স্পষ্ট করেনি এমআরএ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এমআরএ’র পরিচালক মো. জিল্লুর রহমান সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি না। সামগ্রিকভাবে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার জন্যই এ সার্কুলার জারি হয়েছে। তিনি বলেন, সারা দেশে ৭০০-এর বেশি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সার্কুলার জারির পর প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের মাধ্যমে গ্রহীতাদের কাছে আর পণ্য বিক্রির কার্যক্রম চালাবে না বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনে প্রতারণামূলক এমএলএম কার্যক্রমে জাতীয় পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা একটি বীমা কোম্পানির জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। গ্রাহকের আস্থা রয়েছে এমন একটি বীমা কোম্পানির মাধ্যমে খাগড়াছড়িতে বিডাব্লিউবি নামের একটি প্রতিষ্ঠান এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটি চিসানা গ্রুপ অব কোম্পানির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিলেও প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম পরিচালনা করছে পার্বত্য এলাকায়। যে এলাকায় কার্যক্রম চালাচ্ছে সেখানকার কোনো কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স নেয়নি। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী খুলনার সোনাডাঙ্গা ওয়েস্টার্ন প্লাজায় অফিস নিয়ে প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে ‘মিশন ২১’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের পরিদফতর থেকে এক বছরের নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পরবর্তীতে এমএলএম কার্যক্রম পরিচালনার কারণে এই কোম্পানিটির নিবন্ধন আর নবায়ন করেনি কর্তৃপক্ষ। নিবন্ধন নবায়ন না হলেও এখনো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি। জানা গেছে, কুমিল্লা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করায় কোম্পানিটির তিন কর্মকর্তা ২০১৩ সালে গ্রেফতার হয়েছিল। নানা অনিয়মে জড়িত প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠেছিল। কিন্তু এখনো এর কার্যক্রম চলছে। একটি প্রধান অফিস ছাড়াও দেশের আটটি বিভাগে আটটি জোনাল অফিস দ্বারা কোম্পানিটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নবায়ন না করে লাইসেন্সবিহীন কার্যক্রম পরিচালনা করায় কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এমএলএম আইন, ২০১৩-এর ১১ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।

খুলনার স্যার ইকবাল রোডে গোল্ডেন কিং ভবনে অফিস নিয়ে এমএলএমের আদলে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভিজিটিং মার্কেটিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি। ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড এজেন্ট সেন্টার হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে এমএলএম ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই কোম্পানিটির বিরুদ্ধেও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। কোম্পানির জন্য কোনো ধরনের নিবন্ধন বা লাইসেন্স গ্রহণ না করে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে প্রতারণার জাল বিছিয়েছে কোম্পানিটি। মূল শাখাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং খুলনার শাখাটি খুলনা সিটি করপোরেশন হতে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে বলে জানা গেছে।

খুলনা অঞ্চলের সোনাডাঙ্গা নিউমার্কেটে অফিস নিয়ে প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে ম্যাগনেসা বিডি লি. নামে আরেকটি কোম্পানি। লাইসেন্স নবায়ন না করে কার্যক্রম পরিচালনা করায় কোম্পানির শাখাটি এমএলএম আইন ২০১৩ এর ৪৪ নম্বর আইনের ১১ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটিও ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কমিশন এজেন্ট সেন্টার হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করে এমএলএম বাণিজ্য করছে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে অনুমতি নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার দাবি করলেও এর পক্ষে কোনো ধরনের কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। এই কোম্পানিটি এমএলএম আইন ২০১৩ এর ৮৮ নম্বর আইনের ১৪ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

এ ছাড়া ‘আমার বাজার লি.’-নামে সাতক্ষীরার একটি কোম্পানির এমএলএম পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে। এ প্রতিষ্ঠানটিও কোনো লাইসেন্স নেয়নি। আসল পণ্যের নামে নকল পণ্য বাজারজাতকরণেরও অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। একই জেলার তিয়াংশি নামের একটি কোম্পানির বিরুদ্ধেও লাইসেন্স না নিয়ে নকল পণ্যের ব্যবসা করার অভিযোগ উঠেছে।

লাইসেন্স, নিবন্ধন ছাড়া শুধু যে এমএলএমের আদলে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাই নয়, কোনো কোনো কোম্পানি আরও এক ধাপ এগিয়ে সঞ্চয় ও ঋণদান কার্যক্রম চালাচ্ছে- যা ভয়াবহ বলে মনে করছে গোয়েন্দারা। খুলনার পাইকগাছায় ড্রিমটাচ সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামে একটি কোম্পানি গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে এক বছর ধরে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। ঋণ ও সমবায় কার্যক্রম পরিচালনা করলেও অভিযুক্ত কোম্পানিটির সমবায় অধিদফতর থেকে কোনো লাইসেন্স ছিল না। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ এর ৪৭ নম্বর ধারা এবং এমএলএম আইন, ২০১৩ এর ৪৪(১৪) ধারায় আইন ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছে গোয়েন্দারা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এমএলএম কার্যক্রমে মানুষ প্রতারিত হওয়ার পর- অধীনস্থ সংস্থা রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের পরিদফতর আর নতুন করে এ ধরনের কোনো কোম্পানিকে নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে না। এরপরও মফস্বলের মানুষকে টার্গেট করে কিছু কোম্পানি এমএলএম ব্যবসার আদলে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বলে জানা যাচ্ছে। এ ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।

 

সর্বশেষ খবর