শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

আলোচনার বাইরে অনেক জরুরি টিকা

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে রোটা ভাইরাস কলেরা মেনিনজাইটিস টাইফয়েড, জাপানি এনসেফালাইটিস হেপাটাইটিস মাম্পস

শামীম আহমেদ

আলোচনার বাইরে অনেক জরুরি টিকা

দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৭ হাজার নারীর জরায়ুমুখ ক্যান্সার শনাক্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছেন অন্তত ৬ হাজার। কলেরার বিস্তার আবারও বাড়ছে। বাড়ছে রোটা ভাইরাসে আক্রান্তের হার। টাইফয়েডের বিস্তারও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। নতুন করে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে কিউলেক্স মশাবাহিত জাপানিজ এনসেফালাইটিস (মস্তিস্কে প্রদাহজনিত হলুদ জ্বর) ও মেনিগোকক্কাল মেনিনজাইটিস। এ ছাড়া মাম্পস, হেপাটাইটিস-এ, জলবসন্তের মতো রোগগুলোর প্রাদুর্ভাবও বাড়ছে। টিকা দিয়ে এসব রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলেও সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) নেই এসব টিকা। বেসরকারিভাবে কিছু টিকা পাওয়া গেলেও   দাম আকাশছোঁয়া। প্রচারের অভাবে বেশির ভাগ মানুষ জানেই না এসব টিকার খবর। এ ব্যাপারে ইপিআই প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. এস এম আবদুল্লাহ মুরাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাজারে কোন টিকা আসবে সেটি নির্ভর করে ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি কমিটির সিদ্ধান্তের ওপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কথা বলে কমিটি টিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়। আগামী ৪ অক্টোবর থেকে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধী এইচপিভি টিকা দেওয়া শুরু হবে। এ ছাড়া টাইফয়েড প্রতিরোধে আগামী বছর টিসিভি টিকা, ২০২৫ সালে জেই (জাপানিজ এনসেফালাইটিস) টিকা এবং ২০২৬ সালে রোটা টিকা দেওয়া শুরু হবে। টিকা আনার ক্ষেত্রে ২০২৯ সাল পর্যন্ত গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) সরকারকে সহযোগিতা করবে।’

যদিও তথ্য বলছে, গত ছয়-সাত বছর ধরে টিকাগুলো বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে। দেশে রোটাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় ২০১৭ সালের এপ্রিলে ইপিআইর আওতায় বিনামূল্যে টিকাটি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। ছয় বছর পার হলেও অগ্রগতি নেই। অনেক অভিভাবক বাজারে ঘুরে, দালাল ধরে টিকাটি সংগ্রহ করতে পারলেও দুই ডোজের জন্য গুনতে হচ্ছে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। জরায়ু মুখ ক্যান্সারের জন্য দায়ী এইচপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস) প্রতিহতের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে পাইলট প্রকপ্লের আওতায় ৩০ হাজারের মতো কন্যাশিশুকে এইচপিভি টিকা দেওয়া হয়। ছয় মাসের মধ্যে পাইলট প্রকল্পটি শেষ হলেও এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচিটি বিস্তৃত হয়নি। এ ছাড়া অন্যান্য টিকার বিষয় আলোচনাতেই নেই।

এদিকে এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক ও আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবারগুলো। ঘটছে মৃত্যু। সরকারকেও স্বাস্থ্য খাতে দিতে হচ্ছে বড় অঙ্কের ভর্তুকি। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রতি ডেঙ্গু রোগীর পিছনে সরকারের ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৫০ হাজার টাকা। চিকিৎসকরা বলছেন, কিছু রোগ যেমন- জাপানিজ এনসেফালাইটিসের এখনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এই রোগে প্রতি চারজনের একজন মারা যেতে পারেন। টিকাই রোগটি নির্মূলের একমাত্র পথ। সাময়িক কিছু চিকিৎসায় অনেক রোগী সুস্থ হলেও সেই চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। শুরুতেই রোগীপ্রতি খরচ ৮০-৯০ হাজার টাকা। এরপর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় প্রতি মাসে খরচ ৪ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। অনেকে সুস্থ হলেও সারা জীবনের জন্য মানসিক ও শারীরিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) তথ্য বলছে, এরই মধ্যে অর্ধেকের বেশি জেলায় জাপানিজ এনসেফালাইটিস রোগী পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে মেনিনজাইটিস রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে চিকিৎসার জন্য সময় থাকে ২৪ ঘণ্টারও কম। সাধারণত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর মৃত্যু হয়। ২০ শতাংশ রোগী বেঁচে গেলেও প্রতিবন্ধিতাবরণ করেন। টিকাকেই এই রোগ প্রতিহতের একমাত্র অবলম্বন মনে করা হয়। বাংলাদেশে হজযাত্রীদের বাধ্যতামূলক টিকাটি দেওয়া হলেও অন্যদের কিনে নিতে হয়। দূষিত পানি ও খাবার গ্রহণের কারণে হেপাটাইটিস-এ ভাইরাসেও আক্রান্ত হচ্ছে অনেক মানুষ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার রাইটস (বিলস)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ৯৪ শতাংশ রিকশাচালকই সব সময় অসুস্থ থাকেন। এর মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত ৩০ শতাংশ। আর হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জন্ডিস হিসেবে প্রকাশ পায় রোগটি। অস্বাস্থ্যকর খাবার ও দূষিত পানি পানে দেশে টাইফয়েডের প্রকোপও উদ্বেগজনক। এই রোগে আক্রান্ত হলে কিডনি, পরিপাকতন্ত্র, মেরুদণ্ড, স্নায়ুতন্ত্রসহ নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবসন্ত, ভাইরাসজনিত মাম্পস বা গালফোলা রোগেও প্রতি বছর বহু শিশু আক্রান্ত হচ্ছে। দীর্ঘদিন দেশে কলেরা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গত দুই এপ্রিলেই সারা দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আইসিডিডিআর,বি-এর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ডায়রিয়া আক্রান্তদের ২০ থেকে ২৫ ভাগের বেশি রোগী কলেরায় আক্রান্ত। টিকার মাধ্যমে রোগগুলো সহজে প্রতিহত করা যায় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। কলেরার টিকা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গ্লোবাল টাস্ক ফোর্স কলেরা কন্ট্রোল থেকে আমরা সীমিত পরিসরে কলেরা টিকা পাই। এ জন্য হটস্পট শনাক্ত করে টিকা দেওয়া হয়। আগে ঢাকার পাঁচ থানা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প মিলিয়ে ৪৭ লাখ টিকা দেওয়া হয়েছে। আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর থানায় কলেরার হটস্পটে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হবে। আমাদের টিকা কার্যক্রমে গ্যাভি খুবই সন্তুষ্ট। আগামী পাঁচ বছরে ১০ কোটি কলেরার টিকা নিয়ে আসার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। টিকাদানে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বস্বীকৃত। গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২ লাখ ২৫ হাজার গুটিবসন্তের রোগী শনাক্ত হয়, মারা যান ৪৫ হাজার। টিকা কর্মসূচি হাতে নেওয়ায় ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশকে গুটিবসন্তমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে ইপিআই কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৪ সালের মার্চে বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বর্তমানে বাংলাদেশে ইপিআইর আওতায় সরকারিভাবে যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুস্টংকার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, পোলিও, হাম ও রুবেলার টিকা দেওয়া হচ্ছে। ফলে এই রোগগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রোগগুলোর চিকিৎসায় সরকারের ব্যয়ও তেমন নেই। কিন্তু এর বাইরে আরও ১০-১২টি রোগের বিস্তার বাড়ছে, যা টিকার মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব।

সর্বশেষ খবর