শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

চিরকুটেই উন্মোচিত মৃত্যুরহস্য

আলী আজম

প্রায় তিন বছরের তদন্তে কোনো কূলকিনারা করা সম্ভব হয়নি গাজীপুরের টঙ্গীর স্বপন কুমার রায় হত্যা মামলার। মামলার অগ্রগতি জানতে উচ্চপর্যায়ের তদারকির কারণে মাত্র পাঁচ মাসেই দুই দফা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়। এরপর পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) গাজীপুর জেলাকে। পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তাও তদন্তের কূলকিনারা না করতে পেরে অন্ধকারে হামাগুড়ি খাচ্ছিলেন। সবশেষ আড়াই বছরের মাথায় হঠাৎ খুঁজে পাওয়া দুটি চিরকুট ঘুরিয়ে দেয় মামলার তদন্তের মোড়। দফায় দফায় চিরকুটের হাতের লেখা পরীক্ষা এবং কিছু বিষয় পর্যালোচনার পর তদন্ত সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত হন স্বপন কুমার রায় আত্মহত্যা করেছেন।

পিবিআই গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলাটি সার্বিক তদন্তে সাক্ষ্যপ্রমাণে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, ভিসেরা রিপোর্ট, সুরতহাল রিপোর্ট, দুটি চিরকুট পর্যালোচনা করে হত্যা প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করেছি।

মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, গাজীপুরের টঙ্গী পূর্ব থানার মাছিমপুর দক্ষিণ চেয়ারম্যান বাড়ি রোডে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন স্বপন কুমার রায়। মাস্টার্স পাস এই ব্যক্তি টিউশনি করে জীবনযাপন করতেন। গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুরে। ২০২০ সালের ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় বাসা থেকে বেরিয়ে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় পরদিন তার মা নিবেদিতা রায় টঙ্গী পূর্ব থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। নিখোঁজের দুই দিন পর ৩০ মার্চ টঙ্গীর মরকুন পশ্চিমপাড়া কাজী মিজানুর রহমানের বাড়ি সংলগ্ন একটি জলাশয় থেকে স্বপনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিনই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে টঙ্গী পূর্ব থানায় হত্যা মামলা করেন নিহতের মা নিবেদিতা রায়। শুরুতে এই মামলার তদন্ত করেন টঙ্গী পূর্ব থানার এসআই সুব্রত কুমার পোদ্দার। তিনি ১ মাস ১৮ দিন তদন্ত করেন। এরপর মামলার তদন্ত করেন একই থানার এসআই মো. শাহীন মোল্যা। পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে মামলাটি পিবিআই গাজীপুর জেলার কাছে হস্তান্তর করা হয়। পিবিআইয়ের পরিদর্শক এ কে এম রেজাউল করিম মামলার তদন্ত শুরু করেন। পূর্বের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ছয়জনসহ নতুন করে চারজন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পাশাপাশি ভিসেরা ও সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা, প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ, বিভিন্ন দিক থেকে তদন্ত করেন তিনি। তবে কোনোভাবেই হত্যা সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন পিবিআইয়ের পরিদর্শক এ কে এম রেজাউল করিম জানান, ঘটনাস্থলের আশপাশের কোনো সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থলের পার্শ¦বর্তী কোনো দোকানপাট কিংবা ঘর-বাড়ি ছিল না। ঘটনাস্থলটি নির্জন জায়গা। মামলার বাদীসহ তার পরিবারের লোকজনদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি স্বপন কুমার রায় সাঁতার জানত না। তদন্তের একপর্যায়ে পাওয়া দুটি চিরকুটেই বেরিয়ে আসে মৃত্যুরহস্য। চিরকুট দুটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্বপন কুমার রায়ের নিজ হাতে লেখা চিরকুটে পূর্ব থেকেই আত্মহত্যা করার বিষয়ে চিন্তা করত এবং এই বিষয়ে চিরকুটে উল্লেখ আছে। দীর্ঘ তদন্তের পর ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়।

কী ছিল চিরকুটে : ডায়েরিতে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘৭-৮ বছর ঘুমের সমস্যায় ভুগছি। একদমই ঘুম হয় না। না রাতে, না দিনে। টেনশন থাকলে ঘুম আসবে না স্বাভাবিক। কিন্তু আমি টেনশন না করলেও ঘুম আসে না। আনন্দে থাকলেও ঘুম আসে না। ঘুম ঘুম ভাব আসে। রাত এলে আস্তে আস্তে চোখ থেকে ঘুম চলে যেতে থাকে। চোখের সমস্যা, মাথার সমস্যা, নাকি মানসিক সমস্যা কিছুই বুঝতে পারছি না। টেনশন না করে হাসি-আনন্দে থাকলেও ঘুম আসে না। ঘুম না হওয়ার মাত্রা দিন দিন যেন আরও বাড়ছে। কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করে দেখেছি। অনেক হাঁটি, বুকডাউন দেই, উঠবস করি। ভাবী শারীরিক পরিশ্রম করলে রাতে ভালো ঘুম হবে। যত পরিশ্রমই করি না কেন, ঘুম আসে না। দিনে ঘুমাতে চাই না। শুধু রাতে ৬-৭ ঘণ্টা ঘুমাতে পারলেই যথেষ্ট। কিন্তু আমার চোখে বিন্দুমাত্র স্বাভাবিক ঘুম আসে না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। খেলে কোনো দিন ঘুম হয়, কোনো দিন ঘুম হয় না। অনেক বছর ধরে তো ওষুধ খাচ্ছি। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, খেতে খেতে আমি ক্লান্ত। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলে টেনশন করি সেই জন্য ঘুম হয় না। কিন্তু আমি তো ঘুমের ওষুধ বুঝি শুধু টেনশনের জন্য নয়। অন্য কোনো সমস্যা থাকতে পারে। দুশ্চিন্তা যদি থেকে থাকে তা হলে আমি বলব, ঘুম কেন হয় না আমার সব চেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। ঘুম না হওয়ায় আমাকে দিন দিন ভালো করে শিক্ষা। কোনো চাকরি করতে পারি না। টাইমলি যেতে পারি না, কোনো কাজ করতে না পারার কারণে আর্থিক সমস্যায় ভুগছি। তাছাড়া ঘুম না আসার কারণে প্রচুর পরিমাণে শারীরিক খারাপ বোধ করি, দুর্বল বোধ করি, শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, কোনো কিছুতেই উৎসাহ পাই না, আনন্দ পাই না, কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, বাইরে বের হতে ইচ্ছে করে না, চেহারা স্বাস্থ্য অলরেডি নষ্ট হয়ে গেছে, চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে, বয়সের তুলনায় নিজেকে বেশি বয়স্ক মনে হয়, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস একদম কমে গেছে, তবে আত্মহত্যা করার প্রবণতা এখনো আসেনি। ওষুধ ছাড়া যদি ৬-৭ ঘণ্টা রাতে স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারি তাহলে মনে করি আমার সব সমস্যা আমি নিজেই সমাধান করতে পারব। কোনো দিন সিগারেট খাইনি, এখনো খাই না। নেশা করা তো দূরের কথা। আমি ঘুমের ওষুধ খেতে চাই না। তবে চিকিৎসার কথা চিন্তা করে ১ থেকে ৩ মাস বা ৬ মাস খেতে পারি। বেশি না ৬-৭ ঘণ্টা রাতে ঘুমাতে চাই। ঘুম না হওয়া নিয়ে অনেক সমস্যায় আছি। আমার ভবিষ্যৎ কীভাবে চলবে বুঝতে পারছি না। আমি কী করব আপনি বলে দেন। স্বপনের হাতে লেখা আরেকটি প্রায় একই ধরনের চিরকুট পাওয়া যায়। তাতেও ঘুম না আসার কথা লেখা ছিল।

সর্বশেষ খবর