মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুখর কান্তজিউ মন্দির

দিনাজপুর প্রতিনিধি

মুখর কান্তজিউ মন্দির

প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী রাজপরিবারের প্রথা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনাজপুরে শ্রীশ্রী কান্তজিউ যুগল বিগ্রহ নদীপথে নৌকায় পুলিশি প্রহরায় গতকাল সকালে কান্তনগর মন্দির থেকে যাত্রা করে। বিভিন্ন ঘাটে কান্তজিউ বিগ্রহ বহনকারী নৌকা ভেড়ানো হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরেক রূপ কান্তজিউ বিগ্রহ নিয়ে আসাকে কেন্দ্র করে পুনর্ভবা নদীর দুই তীরে ভক্ত-পুণ্যার্থীর ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উৎসব আমেজে পরিণত হয়। প্রায় ২৫ কিলোমিটার নৌপথে বিভিন্ন নদীর ঘাটে ভক্তদের পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে নৌকা দিনাজপুর শহরের রাজবাড়ির মন্দিরে পৌঁছায়।

গতকাল ভোর হতেই স্থানীয় ছাড়াও দূর-দূরান্তের হাজার হাজার ভক্তের পদচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণসহ পুনর্ভবা নদীর ঘাট এলাকা। কড়া পুলিশি নিরাপত্তা ছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরির দলও উপস্থিত ছিল।

গতকাল সকালে দিনাজপুরের কাহারোলের কান্তনগরে নৌপথে দিনাজপুর শহরের রাজবাড়ির উদ্দেশে শ্রীশ্রী কান্তজিউ যুগল বিগ্রহর নৌবহর যাত্রার বিদায় জানান স্থানীয় সংসদ সদস্য ও হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের সহসভাপতি মনোরঞ্জন শীল গোপাল।

ঐতিহ্যবাহী কান্তনগর মন্দির থেকে পূজা-অর্চনা শেষে কান্তজিউ বিগ্রহ পুনর্ভবা নদীর কান্তনগর ঘাটে আনা হয়। পরে নৌবহর নিয়ে দিনাজপুর শহরের সাধুর ঘাটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ প্রায় ২৫ কিলোমিটার নদীপথে নৌকাযোগে আসার পথে হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্ত নদীর দুই কূলে কান্তজিউ বিগ্রহকে দর্শনের জন্য ভিড় জমান। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত হিন্দু পুণ্যার্থীরা বাড়ির ফল, দুধ ও অন্যান্য সরঞ্জাম শ্রীশ্রী কান্তজিউ বিগ্রহকে উৎসর্গ করতে নিয়ে আসেন। এতে নদীর দুই কূল ভক্তদের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কান্তনগর ঘাট থেকে দিনাজপুর শহরের সাধুর ঘাট পর্যন্ত ৩০টি ঘাটে কান্তজিউ বিগ্রহ বহনকারী নৌকা ভেড়ানো হয়। এ কারণে বিভিন্ন ঘাটে ও শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে কান্তজিউ বিগ্রহ সাধুর ঘাটে এসে পৌঁছালে দিনাজপুর রাজদেবোত্তর এস্টেটের সভাপতি ও জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিগ্রহ গ্রহণ করেন। পরে বিগ্রহটি শহরের বিভিন্ন মন্দিরে পূজা-অর্চনা শেষে দিনাজপুরের রাজবাড়ি কান্তজিউ মন্দিরে স্থাপন করা হয়। রাজ দেবোত্তর এস্টেটের এজেন্ট রণজিৎ কুমার সিংহ ও সদস্য শ্যামল কুমার রায় জানান, শ্রীশ্রী কান্তজিউ যুগল বিগ্রহর নৌবহর দিনাজপুরের সাধুর ঘাট থেকে পালকিযোগে রাজবাড়ি যাবে এবং আবার তিন মাস পর আগামী রাস পূর্ণিমার দুই দিন আগে পালকিযোগে কান্তজিউ মন্দিরে ফিরে আসবে। এ সময় কান্তজিউ যুগল বিগ্রহর নৌবহরকে বিদায়ের পর মনোরঞ্জন শীল গোপাল এমপি সাংবাদিকদের বলেন, সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস ধার্মিক মানুষের বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণেই এ দেশে সম্মিলিতভাবে প্রতিটি সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষ অবস্থান করছে।

তিনি বলেন, রাজপরিবারের রীতি অনুযায়ী কান্তজিউ বিগ্রহ ৯ মাস কান্তনগর মন্দিরে এবং ৩ মাস দিনাজপুরের শহরের রাজবাড়িতে অবস্থান করে। এই তিন মাসে রাজবাড়িতে প্রতিদিন প্রভাতি নামকীর্তন ও প্রতি বাংলা মাসের প্রথম শনিবার কমিটির পক্ষ থেকে ভোগের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ভক্ত প্রতিদিন ভোগের ব্যবস্থা করে থাকেন। গতকাল দিবাগত রাত ১২টায় শ্রীশ্রী কান্তজিউ বিগ্রহ দিনাজপুরের রাজবাড়ির কান্তজিউ মন্দিরে স্থাপন করা হয়। এ সময় নদীর কান্তনগর ঘাটে উপস্থিত ছিলেন রাজদেবোত্তর এস্টেটের এজেন্ট রণজিৎ কুমার সিংহ, কাহারোল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জেলা শাখার সভাপতি সুনীল চক্রবর্তী, ডা. ডি সি রায় প্রমুখ।

উল্লেখ্য, দিনাজপুরে রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে। সেই বংশের রাজা প্রাণনাথ ১৭২২ সালে দিনাজপুর শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে কাহারোল উপজেলার কান্তনগর এলাকায় কান্তজিউ মন্দির নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৭৫২ সালে এই মন্দিরের কাজ শেষ করেন তার পোষ্যপুত্র রামনাথ। সেই সময় থেকেই কান্তজিউ বিগ্রহ ৯ মাস কান্তনগর মন্দিরে এবং ৩ মাস দিনাজপুর শহরের রাজবাড়িতে রাখা হয়। জন্মাষ্টমীর একদিন আগে কান্তজিউ বিগ্রহ ধর্মীয় উৎসব-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিনাজপুরের রাজবাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর