বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজধানীতে বেপরোয়া চোর-ছিনতাইকারী

আতঙ্কে নগরবাসী

আলী আজম

রাজধানীতে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোর-ছিনতাইকারীরা। তাদের ভয়ে পথচারীদের তটস্থ হয়ে চলাফেরা করতে হয়। বাসাবাড়ি ফাঁকা রেখে কোথাও যেতে ভয় পাচ্ছেন নগরবাসী। শুধু রাত নয়, দিনদুপুরেও এখন চুরি-ছিনতাই হচ্ছে। চোর বা ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। তারা সাধারণ মানুষের মতোই চলাফেরা করছে। সুযোগ বুঝে ফিল্মি স্টাইলে চুরি বা ছিনতাই করে বীরদর্পে চলে যাচ্ছে। সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাই কাজে ব্যবহার করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল। এদের টার্গেট ভ্যানেটিব্যাগ, হাতব্যাগ, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন সেট। এদিকে, চোরচক্র সুযোগ বুঝে ফাঁকা বাসা বা অফিসে হানা দিচ্ছে। তারা নগদ টাকা, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন বা স্বর্ণালংকার চুরি করে লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে।

ঢাকার প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে ছিনতাই বেপরোয়া হারে বাড়ছে। এই ছিনতাইকারীদের হাতে যখন তখন প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। অনেকে আবার আহত হয়ে বয়ে বেড়াচ্ছেন  করুণ পরিণতি। ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ হারানো বা নির্মম ঘটনার শিকার এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। এর বাইরেও অহরহ ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এমনকি ছিনতাইয়ের কবল থেকে মন্ত্রী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রক্ষা পাচ্ছে না। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে প্রায়ই মূল্যবান সামগ্রী হারাতে হচ্ছে। রাত গভীর হলে যানবাহন ও মানুষের সমাগম কমে গেলে ছিনতাইকারীরা বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়ে। তখন বেশ কিছু এলাকায় রিকশা ও হেঁটে চলাচলকারীদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশি অস্ত্রধারী ও দলবদ্ধ এসব ছিনতাইকারীর সঙ্গে যুদ্ধ করাও কঠিন। একটু বল প্রয়োগ করতে গেলে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় থাকে। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এদিকে, চুরি ও ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনাই থানা-পুলিশের কাছে যায় না। চুরি-ছিনতাইয়ের শিকার বেশিরভাগ মানুষই হয়রানি ও ঝামেলার আশঙ্কায় মামলা করেন না। এতে চুরি ও ছিনতাইয়ের মামলা হয় কম। পুলিশ বলছে, চুরি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা জানালে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অনেক পেশাদার চোর বা ছিনতাইকারী আটকের পর আদালতের মাধ্যমে দ্রুত জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই ধরনের অপরাধ করছে। চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে তেজগাঁও বিভাগ এলাকায়। এর পরের স্থানে পর্যায়ক্রমে রয়েছে রমনা ও মতিঝিল বিভাগ। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনা কমাতে হলে সামাজিক নজরদারি বাড়ানোসহ একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার প্রবণতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে উত্তরা থেকে ট্রাকে ঘরের আসবাবপত্র ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দুই সহোদর আনোয়ার ও দেলোয়ার। তাদের ট্রাকটি ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তেই উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের বিএনএস সেন্টারের সামনে প্রধান সড়কে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। দুর্বৃত্তচক্র তাদের গতিরোধ করে টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখন দুই ভাই ছিনতাইকারীদের ধাওয়া দিয়ে আটকের চেষ্টা করেন। আর তখনই ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে দুই ভাইকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দেলোয়ার হোসেন। তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর ফিল্মি স্টাইলে দিনদুপুরে আইএফআইসি ব্যাংকের পল্টন শাখায় ঢুকে ২০ লাখ টাকা ছিনতাই করে ডেমরা পুলিশ লাইনে ক্লোজ হয়ে থাকা পুলিশের দুই সদস্য কনস্টেবল মাহাবুব ও কনস্টেবল আসিফসহ পাঁচজন। ঘটনার পর টাকা উদ্ধার এবং অভিযুক্ত দুই কনস্টেবলসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। গত ২৭ আগস্ট মিরপুরের ৬০ ফুট এলাকার একটি অফিসে প্রবেশ করে এক নারী। তিনি দ্বিতীয় তলায় উঠে সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন। সেটি না পেরে অভিনব কৌশল হিসেবে ছাতা দিয়ে প্রথমে মুখ লুকানোর চেষ্টা চালান। পরে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ঢেকে রাখেন সেই ছাতা দিয়ে। পরে অফিসে থাকা নগদ টাকা ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যান ওই নারী। এ ঘটনায় ওই নারীসহ দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ২৯ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের একটি বাসার গ্রিল কেটে ঢুকে ৩৭ ভরি স্বর্ণের গহনাসহ মালপত্র নিয়ে পালায় চোরচক্র। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, চুরি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেই আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার এবং চুরি বা ছিনতাই হওয়া মালামাল উদ্ধার করা হচ্ছে। গত তিন মাসে উল্লেখযোগ্য চোর ও ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। চুরি বা ছিনতাইকারী আটকের পর আদালতে পাঠানো হচ্ছে। আদালত থেকে তারা দ্রুত জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এদের নিশ্চিহ্ন করা যাবে না, তবে আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। ঢাকা মহানগরীকে চুরি ও ছিনতাইমুক্ত করে নগরবাসীর নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিতকরণ এবং অপরাধ ভীতি দূর করতে ডিএমপির পক্ষ থেকে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।

 জানা গেছে, ৭ অক্টোবর ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে ১৯ সদস্যের এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ছিনতাই যেমন বাড়ছে ঠিক তেমনি চুরিও বাড়ছে। আর্থিক সংকটে থাকা বা মাদকসেবীরা চুরি-ছিনতাইকে পেশা বা কাজ হিসেবে বেছে নিচ্ছে। চুরি বা ছিনতাইকে বড় কোনো ধরনের অপরাধ হিসেবে এখনো গণ্য করা হয় না। ফলে যারা গ্রেফতার হয়, তারা আদালত থেকে দ্রুত জামিনে বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

সর্বশেষ খবর