বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কোহিনুর হীরার দুর্গ গোলকুন্ডা

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও কাজী শাহেদ, হায়দরাবাদ (ভারত) থেকে

কোহিনুর হীরার দুর্গ গোলকুন্ডা

কোহিনুর, জ্যাকব, হোপ, নীলম এই বহুমূল্যবান হীরাগুলো মিলেছিল ভারতের হায়দরাবাদের গোলকুন্ডা দুর্গ থেকে। হাজার বছরের ইতিহাস প্রতিটি পরতে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই দুর্গ। ৪৮০ ফুট উঁচু এই দুর্গ থেকে পাখির চোখে দেখা যায় প্রায় গোটা হায়দরাবাদ শহর। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। ঢিমেতালে সিঁড়ি ভেঙে গল্প বলে চলেছেন দুর্গের গাইড শেখ বাবা। তার গল্পে যেন সেই কয়েক শ বছর আগের স্মৃতি ফুটে উঠছিল হায়দরাবাদ সফররত বাংলাদেশ সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্যদের চোখে। দুর্গের প্রবেশ ফটকে ঢুকতেই চোখে পড়ে দুটি সদর দরজা। যার একটি দিয়ে হাতি ঘোড়া নিয়ে প্রবেশ করতেন বাদশা আর অন্য দরজাটি ছিল সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য। প্রবেশ ফটক পেরিয়ে ভিতরে যেতেই  দেখা মেলে এক তেলেসমাতি কান্ডের। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন গাইড শেখ বাবা। দু-হাতে করজোড়ে তালি দিলে উপরের মহল থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে প্রতিধ্বনি, যে কৌশল সেসময় ব্যবহার করা হতো শত্রুপক্ষের আনাগোনা মহল পর্যন্ত সিপাহিদের কানে পৌঁছাতে। এই দুর্গের প্রথমে নাম ছিল মাটফোর্ট। স্থানীয় ভাষায় বলা হতো গোল্লাকুন্ড, যার মাঝে গোল্লা অর্থ গোলাকার ও কুন্ড অর্থ পাহাড়। বাহমানি সুলতান কুতব শাহ এই দুর্গ নির্মাণ শুরু করেন যা সম্পন্ন হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৬২ বছর। সুলতান অবশ্য তার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি এই দুর্গ। দুর্গ নির্মাণে ইট, বালি, সুরকির সঙ্গে মেশানো হয়েছিল ওড়ুত অর্থাৎ অড়হর ডাল, যাতে শক্তিশালী হয় দুর্গের প্রাচীর; মোকাবিলা করতে পারে শত্রু পক্ষের আক্রমণ। দুর্গের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে এগিয়ে চলতে থাকে গল্প। দেখা মেলে চৌকোনা দুটি ঘরের, যাতে নেই কোনো দরজা জানালা- আছে শুধু চারকোনায় চারটি পেরেক। গাইড জানান, এই পেরেকে ভারী পর্দা টাঙিয়ে আলাদা করা হতো দুটো ঘরকে। এখানে বসতেন বাদশাহর হিসাবরক্ষক দুই ভাই মান্দানা ও আকান্না। এই গল্পের মাঝে বার বার মনে উঁকি দিচ্ছিল কোহিনুর হীরার খোঁজ। জানা যায় গোলকুন্ডার অদূরে বিজয়বরা কুত্তুর গ্রামের এক বয়স্ক নারী পেয়েছিলেন এই হীরা। হীরাটি পরে উপহার হিসেবে বাদশাহকে দিয়েছিলেন সেই বয়স্ক নারী। এরপর এই কোহিনুর হীরার জায়গা হয় গোলকুন্ডার নাগিনা গার্ডেনে। এরপর বহুবার বহিঃশত্রুর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে গোলকুন্ডা আর লুট হয়েছে কোহিনুর হীরা। হাঁটতে হাঁটতেই জিজ্ঞাসু মনে প্রশ্ন জাগে কীভাবে এই সুউচ্চ দুর্গে মিলত পানীয় জল? জানা যায়, ২০-২৫ জন লোক ৪৮০ ফুট দূর থেকে চরকা ঘুরিয়ে সুউচ্চ এই দুর্গে তুলত পানীয় জল। হাঁটতে হাঁটতেই হাতের দুই পাশে দেখা মেলে সেই আমলের দুটি লন্ড্রির, যার একটি রাজ পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য ছিল আর অন্যটি ছিল বাদশাহ ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য। দুর্গ থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য ছিল গুপ্ত রাস্তা যদিও তা পরে বন্ধ করে দেয় সরকার। এই  দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় আছে মহাকালী ও জগদম্বা মন্দির, যা হায়দরাবাদের প্রথম মন্দির হিসেবে মনে করা হয়। দুর্গে বেড়াতে এসেছিলেন পানগাঁওর অসিত কুমার, যার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, নিজ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করে দিতে নিজ সন্তানদের নিয়ে এসেছেন তিনি। দুর্গের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যটক বেড়াতে আসেন তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদের বহু প্রাচীন এই দুর্গে।

সর্বশেষ খবর