শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬ বছর আজ

সন্ত্রাস চাঁদাবাজিতে ম্লান পাহাড়ের উন্নয়ন

শিমুল মাহমুদ, পার্বত্যাঞ্চল থেকে ফিরে

সন্ত্রাস চাঁদাবাজিতে ম্লান পাহাড়ের উন্নয়ন

বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের ১০ ভাগ নিয়ে গঠিত তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে মাত্র ১৮ লাখ মানুষের বসবাস। অথচ পাহাড়ের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের সম্ভাবনা জাতীয় অর্থনীতিতে কোনো কাজেই লাগত না। যে পাহাড়ে ছিল না সড়ক নেটওয়ার্ক। বিদ্যুতের আলোবিহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল অধিকাংশ জনপদ। ছিল না কোনো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর সে পাহাড়ে এখন সড়ক, সেতু, কালভার্ট, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত। পরিকল্পিত উন্নয়নে বদলে গেছে তিন পার্বত্য জেলার অবহেলিত জনপদ। পাহাড়ের মানুষ এখন ফল-ফসলের উচ্চমূল্য পাচ্ছে। এখন পাহাড়ের কলা, পেঁপে, কমলা, আম, কাঁঠাল, আনারসসহ নানা ফল-ফসল নিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক সমতলে নেমে আসে। কিন্তু সরকারের নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের সাফল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬ বছর পরও পাহাড়ে কাক্সিক্ষত শান্তি ফিরেনি। বন্ধ হয়নি রক্তপাত, খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি। শুধু গোষ্ঠীগত স্বার্থে চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি ভেঙে এখন চারটি সংগঠনে বিভক্ত হয়েছে। যে এলাকায় যাদের আধিপত্য সেই এলাকায় তারাই চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস করছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবাদে এখন মোবাইল ফোনে হুমকি আসে, আসে চাঁদার চাহিদা। চাঁদার পেমেন্টও হয়ে যায় মোবাইলে। পাহাড়ের নিরুপায় সাধারণ মানুষ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এই প্রেক্ষাপট সামনে রেখে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্যাঞ্চলে শান্তির বার্তা নিয়ে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৬ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। পাহাড়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ শান্তিচুক্তির বার্ষিকী পালিত হবে। সূত্র জানায়, তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে সশস্ত্র সন্ত্রাস, প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিয়মিত লাশ পড়ছে। রক্ত ঝরছে সাধারণ মানুষের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজির কারণে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে গত সাড়ে ২৫ বছরে ১ হাজার ৩৫৫ জন খুন হয়েছেন। গুম হয়েছে প্রায় সোয়া ২ হাজার। বছরে তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজিতে লিপ্ত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। সরকার বলছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার ৯৮টি উপধারার মধ্যে ৮৬টি উপধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। চারটি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। আর আটটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারাই তারা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্লেখ্য, পার্বত্য চুক্তি তথা শান্তি চুক্তির অধিকাংশ ধারা সরকার বাস্তবায়ন করলেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পক্ষে স্বাক্ষরকারী জেএসএস প্রধান সন্তু লারমার জন্য মাত্র দুটি ধারা অস্ত্র সমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করার বিষয় ছিল-সেটাই তিনি বাস্তবায়ন করেননি। এখন সন্তু লারমা দাবি করেন, তাদের কোনো সশস্ত্র গ্রুপ নেই। অথচ জনসংহতি সমিতিসহ সশস্ত্র গ্রুপগুলো দেশি-বিদেশি উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। পাহাড়কে অস্থিতিশীল করতে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে তাদের সশস্ত্র সদস্যরা ভারী অস্ত্রসহ ধরা পড়ার ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

পার্বত্য শান্তিচুক্তির উদ্যোক্তা আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিক তিন মেয়াদে শান্তিচুক্তির আলোকে পাহাড়ের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বদলে গেছে পাহাড়ের লাখ মানুষের জনজীবন। শান্তিচুক্তির আগে তিন পার্বত্য জেলায় প্রাইমারি স্কুল ছিল ১ হাজার ২৫২টি। চুক্তির পরে হয়েছে আরও ৮১২টি। হাইস্কুল ছিল ১৯৮টি। চুক্তির পরে স্কুল করা হয়েছে আরও ৪০৪টি। কলেজ ছিল ২৫টি। নতুন হয়েছে ২৬টি। তিন জেলায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। সেখানে তিনটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। হাসপাতাল ছিল ৯১টি। চুক্তির পরে হয়েছে আরও ১২১টি। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ছিল ২ হাজার ২৬৬টি। চুক্তির পরে হয়েছে আরও ৫ হাজার ৩৩টি। যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। পাকা রাস্তা করা হয়েছে ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তা নির্মিত হয়েছে ৭০০ কিলোমিটার। ৯ হাজার ৮৩৯ কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে ২০৫ কিলোমিটার। শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নের ফলে পাহাড়ের মানুষ দেশের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তারা শিক্ষা, কর্মসংস্থানে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষিভিত্তিক আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হচ্ছে পাহাড়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ। এদিকে পার্বত্যবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের নানা প্রচেষ্টা ম্লান হয়ে যাচ্ছে চার সন্ত্রাসী গ্রুপের সন্ত্রাস ও জবরদস্তিতে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে জনসংহতি সমিতি-জেএসএস (মূল) ও ইউপিডিএফ (মূল) এর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও গুম-খুনের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। সংস্কারপন্থি হিসেবে এই দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর দুটি উপ-দলও সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে জড়িত। তাদের সঙ্গে একই তৎপরতায় যুক্ত হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। ভুক্তভোগী বাঙালি ও পাহাড়িরা অভিযোগ করেন, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গাছের ফল, ফসল, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষক-শ্রমিক-মৎস্যজীবী, সড়কে চলাচলকারী যানবাহন, চাকরিজীবী, স্থানীয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবার, দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানি, জমি কেনাবেচা, এমনকি ডিম-কলা বিক্রি করতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। তিন পার্বত্য জেলায় জনসংখ্যায় পাহাড়ি-বাঙালি অনুপাত প্রায় সমান। সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিরা শান্তির পক্ষে। কিন্তু আধিপত্যের লড়াই, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত তাদের জীবন। অভিযোগ রয়েছে, সশস্ত্র গ্রুপের শীর্ষ নেতারা চাঁদাবাজির টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। বিদেশেও বাড়ি আছে কারও কারও।

উল্লেখ্য, পার্বত্য শান্তি চুক্তির আগে তিন পার্বত্য জেলা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। চুক্তির পর গত ২৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নে বদলে গেছে তিন পার্বত্য জেলা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আলাদা কোটা, সরকারি চাকরি, পার্বত্য ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হয়েছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিদ্যুৎ সংযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তথ্য ও প্রযুক্তি, যোগাযোগ উন্নয়ন, মসজিদ, মন্দির, বিহার, সমাজকল্যাণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, পর্যটনসহ অসংখ্য খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে। সরকারের এসব উন্নয়নের সাফল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসে, চাঁদাবাজিতে। স্থানীয়রা বলেছেন, পার্বত্য চুক্তির পর সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে পার্বত্য তিন জেলায় আর্থ-সামাজিক খাতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করায় তিন দিনের দূরত্বের পথ চলে এসেছে তিন ঘণ্টার ব্যবধানে। মানুষের জীবন অনেক সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যের হয়ে গেছে। পাহাড়ি এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, শান্তিচুক্তি সম্পাদনের ফলে পার্বত্যাঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে স্থানীয় মানুষের জীবনে গতি সঞ্চার হয়েছে। খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, যোগাযোগব্যবস্থা অনেক ভালো হওয়ায় জেলার যে কোনো জায়গায় কোনো অপরাধ ঘটলে দ্রুততম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। এখন অপরাধ অনেক কমে গেছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর