শিরোনাম
সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রেললাইন কেটে নাশকতায় কাউন্সিলরসহ গ্রেফতার ৭

গাজীপুর প্রতিনিধি

গাজীপুরের বনখড়িয়ায় ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের রেললাইন কেটে নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এক কাউন্সিলরসহ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতাররা সবাই বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মী। তারা হলেন- গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নগরের রাজবাড়ি উত্তরপাড়া এলাকার মো. হাসান আজমল ভূঁইয়া (৫০), নেত্রকোনার মদন থানার বারইবাজার এলাকার জান্নাতুল ইসলাম (২৩), ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার বান্দিয়া এলাকার মেহেদী হাসান (২৫), গাজীপুর সদর থানার ভানোয়া এলাকার জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয় (৩৫), সদর থানার উত্তর ছায়াবিধি এলাকার শাহানুর আলম (৫৩), কানাইয়া পূর্বপাড়ার মো. সাইদুল ইসলাম (৩২) ও মধ্য ছায়াবিধি এলাকার সোহেল রানা (৩৮)।

গতকাল দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম। তিনি বলেন, দেশ ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। পুলিশ কমিশনার বলেন, একটি নাশকতার মামলা তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারি, একদল দুষ্কৃতকারী গত ১৩ ডিসেম্বর ভোর আনুমানিক ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রহলাদপুর ইউনিয়নের বনখড়িয়া এলাকায় চিনাই রেলব্রিজের পাশে রেললাইন কেটে ফেলে। এর ফলে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটির ইঞ্জিন ও সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে আসলাম নামে একজন নিহত এবং ১০ জন আহত হন। ঘটনার পরপরই গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে শনিবার দুষ্কৃতকারী দলের সদস্য জান্নাতুল ইসলাম ও মেহেদী হাসানকে আটক এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ট্রেনে নাশকতা ঘটানোর জন্য তারা গাজীপুর সিটির কোনাবাড়ী এলাকা থেকে ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একটি মাইক্রোবাস ঢাকা যাওয়ার কথা বলে ভাড়া করে। পরে সেই গাড়ি নিয়ে গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। এ সময় মাইক্রোবাসে থাকা সবাই মুখোশ পরা ছিল। এ অবস্থায় ড্রাইভার ভয় পেয়ে তাদের ঢাকায় না যাওয়ার এবং মুখোশ পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে তাদের একজনের মুখোশ খুলে। এ সময় তাদের চেনে কি না জানতে চাইলে ড্রাইভার চিনতে পারলেও কিছু বলতে সাহস পাননি। পরে তারা মাইক্রোবাস নিয়ে রেললাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে বের হয়। পথে গাজীপুর সিটির শিববাড়ী, জোড় পুকুরপাড় এলাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গাড়িতে ওঠায়। পরে তারা গাজীপুর শহরের জোড় পুকুরপাড়ের ইবনে সিনহা তোহার বাড়ি থেকে রেললাইন কাটার যন্ত্রপাতি, দক্ষিণ সালনার উসমান গণির ভাড়া দেওয়া ‘বাঁশ বাগান’ রেস্টুরেন্ট থেকে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার গাড়িতে ওঠায়। তারা এসব সরঞ্জাম নিয়ে গাজীপুর সিটির শিববাড়ী মোড় থেকে দুজনকে গাড়িতে ওঠায়। এরপর গাজীপুরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করে রাত ১০টার দিকে শহরের শিমুলতলী এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খায়। সেখান থেকে ১১টার দিকে বের হয়ে ফের গাড়িতে সময় ক্ষেপণের জন্য বিভিন্ন অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বনখড়িয়া এলাকায় ৪-৫ কিলোমিটার দূরের বনের পাশে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে তারা গ্যাস সিলিন্ডারসহ সরঞ্জামাদি নিয়ে চিনাই রেলব্রিজের পাশে যায়। সেখানে গিয়ে তারা সুযোগ বুঝে ৩ থেকে ৪টার মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল সড়কের ২০ ফুট রেললাইন গ্যাসকাটার দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর কিছু সময় পর ওই রেলপথে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ভোর ৪টা ১৫ মিনিটের দিকে দুর্ঘটনার শিকার হয়।

পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, ঘটনা ঘটিয়ে তারা (দুষ্কৃতকারীরা) গাড়ি নিয়ে ঢাকা চলে যায়। সেখানে গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে চারজন গাড়ি থেকে নেমে যায় এবং বাকিরা মিরপুরে নামে। মিরপুরে নেমে তারা নিজেদের কাছে টাকা না থাকায় ফোনে অন্য একজনকে ড্রাইভারের নম্বরে টাকা পাঠাতে বলে। সেই মোতাবেক এক ব্যক্তি ড্রাইভার সাইফুলের বিকাশে ৮ হাজার ১০০ টাকা পাঠায়। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবি (উত্তর) বিভাগের একাধিক টিম অভিযান চালিয়ে ট্রেনে নাশকতায় জড়িত জান্নাতুল ইসলাম এবং মেহেদী হাসানকে আটক করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা গাজীপুর সিটির ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হাসান আজমল ভূঁইয়া। পরে হাসান আজমল ভূঁইয়া, জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয়, শাহানুর আলম, মো. সাইদুল ইসলাম ও সোহেল রানাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় নাশকতার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নকারীরা সবাই বিএনপি এবং অঙ্গ-সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মী।

গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গত ১১ ডিসেম্বর রাতে গাজীপুর সিটির কাউন্সিলর ও সাবেক বিএনপি নেতা আজমল র্ভূইয়ার বাসাসহ বিভিন্ন স্থানে মিটিংয়ে রেললাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়। ওই মিটিংয়ে আলোচনা হয়ে যে, দলের উচ্চ পর্যায় থেকে বড় কিছু করার চাপ আছে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হবে। সরকারের বর্তমান নির্বাচনি কার্যক্রমকে বিতর্কিত করা, রাষ্ট্রীয় সুশৃঙ্খল পরিবেশকে নষ্ট, জনমনে ভীতিসঞ্চার এবং এর মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি, হরতাল-অবরোধ সফল করার জন্য ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য রেললাইনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়েছে। মাইক্রোবাসের চালক প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

প্রেস ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহা. আহমার উজ্জামান, গাজীপুর পিবিআই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান, রেলওয়ে পুলিশের পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন, গাজীপুর মেট্রোপলিটনের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান ও আবু তোরাব মো. শামসুর রহমান।

গাজীপুর পিবিআইর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান জানান, রেললাইন কেটে নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার সাতজনের মধ্যে তিনজন গতকাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা হলেন, নেত্রকোনার মদন থানার বারই বাজারের জান্নাতুল ইসলাম, ময়মনসিংহের ভালুকা থানার বান্দিয়া এলাকার মেহেদী হাসান এবং গাজীপুর সিটির উত্তর ছায়াবিথী এলাকার শাহানুর আলম। গ্রেফতার অন্য চারজনকে পাঁচ দিনের করে রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। মামলাটি তদন্ত করছে গাজীপুর পিবিআইর ইন্সপেক্টর সালাউদ্দিন।

 

সর্বশেষ খবর