শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

কর্মকর্তাদের যাওয়া হচ্ছে না, তাই চালুও হচ্ছে না

সাখাওয়াত কাওসার

কর্মকর্তাদের যাওয়া হচ্ছে না, তাই চালুও হচ্ছে না

কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়া হচ্ছে না। তাই চালু হচ্ছে না কানাডায় ই-পাসপোর্ট সেবা। ফলে বিপাকে পড়েছেন কানাডায় অবস্থানরত শিক্ষার্থীসহ হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি। পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের অনেকেই যেমন দেশে আসতে পারছেন না, তেমনি সংগ্রহ করতে পারছেন না কানাডায় কাজের অনুমতিপত্র (ওয়ার্ক পারমিট) কিংবা স্থায়ী বসবাসের (পিআর) অনুমতি। অন্যদিকে, বিগত ২১ মাস ধরে কোটি টাকার মেশিন বাক্সবন্দি থাকার কারণে দেখা দিয়েছিল নানা ত্রুটি। টেকনিশিয়ানরা গত ৩ নভেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত অনেক কষ্টে তা সচল করেছেন। তবে বাংলাদেশ থেকে একদল কর্মকর্তার কানাডায় যেতে না পারার কারণে আটকে আছে ‘সুইচ টিপে’-এর উদ্বোধন। ই-পাসপোর্ট সেবা চেয়েও পাননি এমন দুজন কানাডা প্রাবাসী বাংলাদেশির হাইকমিশনে পাঠানো ইমেইল বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে এসেছে। এদের একজন কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহিম ফয়সাল সিফাত। তিনি হাইকমিশনে পাঠানো এক ইমেইল বার্তায় লিখেছেন, ‘আমি পাসপোর্ট রিনিউ করার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আমার আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই পাসপোর্ট তারা প্রসেস করতে পারবেন না। কেননা এটি ই-পাসপোর্ট। এই মুহূর্তে আমার কী করার আছে? পোস্ট গ্রাজুয়েট ওয়ার্ক পারমিট পেতে অনতিবিলম্বে আমার পাসপোর্ট করা প্রয়োজন।’

১৩ সেপ্টেম্বরে পাঠানো ফাহিমের এই ইমেইলের জবাব দেওয়া হয়েছে ৪ ডিসেম্বর। তাতে হাইকমিশন বলছে, ‘কানাডায় ই-পাসপোর্ট সেবা এখনো চালু হয়নি। খুব দ্রুতই এই সেবা চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’ কিন্তু কবে চালু হবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি কমিশন। এদিকে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করতে না পারায় কানাডার মতো উচ্চব্যয়ের দেশে বেকারত্ব নিয়ে হতাশায় ভুগছেন ফাহিম।

একই সমস্যায় পড়েছেন ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদাব আলী শারিন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। যেহেতু তার ই-পাসপোর্ট, কীভাবে তা রিনিউ করা যাবে তা জানতে চেয়ে একাধিকবার হাইকমিশনে যোগাযোগ করলেও কেউ সদুত্তোর দিতে পারেনি।

ভুক্তভোগীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে অধিকতর খোঁজখবর নিতে গিয়ে পাওয়া গেছে চমকপ্রদ সব তথ্য। যাতে উঠে এসেছে মন্ত্রণালয় এবং পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তাদের খামখেয়ালিপনার চিত্র।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন বাক্সবন্দি থাকার কারণে ই-পাসপোর্টের মেশিনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে দুই টেকনেশিয়ান ৩ নভেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত বহু কষ্টে সেগুলো সচল করতে সমর্থ হন। এবার সব প্রস্তুতি শেষ করেও মাসের পর মাস ধরে ই-পাসপোর্ট সেবা চালু করতে পারছে না কানাডায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাসপোর্ট অধিদফতর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এমন বিলাসিতা ও খামখেয়ালিপনায় বিপাকে পড়েছেন কানাডায় অবস্থিত শিক্ষার্থীসহ হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি। হাইকমিশনে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় প্রতিদিনই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা হারানো পাসপোর্ট পুনরায় ছাপার আবেদনকারীদের।

গত ৬ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরীকে পাঠানো অটোয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের পাঠানো এক চিঠির সূত্রে জানা যায়, গত ৩১ অক্টোবর হাইকমিশনারের অনুরোধে জরুরিভিত্তিতে আমেরিকার ভেরিডোস কোম্পানির দুজন টেকনিশিয়ান প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপনের পাশাপাশি পাসপোর্ট অধিদফতরের মূল সার্ভারের সঙ্গে কমিশনের সংযোগ স্থাপনের কাজ শেষ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কর্মকর্তাদের অন্য আরেকটি বিশেষ দল কানাডায় গিয়ে উদ্বোধন না করা পর্যন্ত এই কার্যক্রম চালু করা যাবে না।

ওই চিঠিতে হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘এটি খুবই অনভিপ্রেত এই কারণে যে, ই-পাসপোর্ট সেবা পেতে দুর্ভোগ পোহাতে থাকা মানুষের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।’ ওই চিঠিতে স্বরাষ্ট্র সচিবকে আনুষ্ঠানিকতার জন্য কর্মকর্তাদের কানাডায় প্রেরণের জন্য বিলম্ব না করে ৮ নভেম্বর থেকেই সেবাটি চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালককে নির্দেশ দিতেও অনুরোধ করেন হাইকমিশনার ড. খলিল।

পর পর এমন আরও দুটি চিঠি পাঠালেও কোনো জবাব দেয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠির জবাব না দিলেও গত ১৯ নভেম্বর পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নুরুল আনোয়ারের নেতৃত্বে ৫ কর্মকর্তার একটি দলের কানাডা ভ্রমণের জন্য ফের একটি সরকারি আদেশ (জিও) জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, স্থাপন নয়, কর্মকর্তারা সেখানে যাবেন, ই-পাসপোর্ট সেবাটিকে পরিচয় (ইন্ট্রোডিউসিং) করিয়ে দিতে।

জানতে চাইলে কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান বলেন, আমেরিকা, ম্যাক্সিকোসহ প্রায় সব দেশেই ই-পাসপোর্ট সেবা চালু হয়েছে। কানাডায়ও সব যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছায় ২০২১ সালের মার্চে। এরপর বিভিন্ন সময় তাগাদা দিয়েও ঢাকা থেকে কোনো টেকনিক্যাল টিম না আসায় সংযোগটি চালু করা যায়নি। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কানাডায় এ উপলক্ষে যে অফিসিয়াল ডেলিগেশনটি আসবে, সেটিতে কারা থাকবেন তা ঠিক করতে না পারায় এই দেরিটি হয়েছে। আমরা তাদের পরিষ্কার করে বলেছি, উদ্বোধন পরেও করা যাবে, সেবাটি আগে চালু হোক। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু তারা হয়তো ভাবছেন, চালু হয়ে গেলে তাদের কানাডায় আসার যৌক্তিকতা আর থাকবে না।’

এই কার্যক্রমে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন হাইকমিশনার। তিনি বলেন, অটোয়ায় আমাদের অফিসে চারটি মেশিন বসানোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা আমাদের ছয়টি মেশিন পাঠিয়েছে। আমাদের দুটি এমআরপি মেশিন রাখতে হচ্ছে। ফলে চারটি ই-পাসপোর্ট মেশিনের কোনো ব্যবহার হবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুরু থেকেই কার্যক্রম চালুর জন্য কোন কোন কর্মকর্তা এবং টেকনিশিয়ান কানাডায় যাবেন তা নির্ধারণ করতে না পারায় উত্তর আমেরিকার অন্য দেশগুলোতে চালু হয়ে গেলেও কানাডায় এখন পর্যন্ত ই-পাসপোর্ট সেবা চালু করতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। একপর্যায়ে সেই অনিশ্চয়তা দূর করে নির্ধারণ করা হয় কারা যাবেন কানাডা সফরে। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আইয়ুব চৌধুরীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের কানাডা সফরের জন্য সরকারি আদেশ জারি হয়। তাতে বলা হয়, কানাডার অটোয়া মিশনে ই-পাসপোর্ট সেবা চালুর জন্য ‘ইমপ্লিমেন্টেশন অব ই-পাসপোর্ট অ্যান্ড অটোমেটেড বর্ডার কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ প্রজেক্ট’-এর আওতায় ওই সাত কর্মকর্তা অনতিবিলম্বে ছয় দিনের সফরে কানাডা যাবেন। কিন্তু করোনা এবং সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির আলোকে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা শুরু হলে সেই সফর আর বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর দফায় দফায় চিঠি পাঠিয়েও এই সেবা আর চালু করতে পারেনি হাইকমিশন।

এ প্রসঙ্গে গতকাল কথা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব  আবদুল্লাহ আল মাসুদ চোধুরীর সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনা, সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতিসহ নানা কারণে বিষয়টি পিছিয়ে ছিল। তবে নির্বাচনের পর একটি টিম কানাডা যাবে। সব কিছু রেডি।

সর্বশেষ খবর