সরকারের সঞ্চয় স্কিম থেকে গ্রাহকদের টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্রে যে পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে, তার চেয়ে বেশি অর্থ তুলে নিয়েছেন গ্রাহক। বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার এই হার আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ। গ্রাহকরা বলছেন, জীবনযাত্রার ব্যয় সামাল দিতে সঞ্চয় ভাঙছেন অনেকেই। একই সঙ্গে সরকারের কিছু কঠোর নিয়মের কারণেও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। স্ত্রী আর দুই সন্তানের সংসারে দুজনই চাকরি করেন রাজধানীতে বসবাসকারী আনোয়ার হোসেন। তাদের আয়েই চলে সংসার। গত পাঁচ বছর ধরে সন্তানদের পড়ালেখা, চিকিৎসা ও অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়েনি আয়। খরচ মেটাতে পাঁচ বছর আগে করা ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙতে হচ্ছে আনোয়ার হোসেনের। তিনি বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ মেটাতে নতুন করে সঞ্চয় তো করতে পারছিই না, উল্টো পাঁচ বছর আগের করা ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেললাম। শুধু আনোয়ার হোসেন নন, তারমতো অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তকে সংসার চালাতে সঞ্চয়পত্র ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেকেই সঞ্চয়পত্র ভাঙছেন চাহিদামতো মুনাফা না পাওয়ায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে সঞ্চয়পত্র ভাঙতে আসা সুলতানা পারভীন বলেন, এখন যে পরিমাণ টাকা মুনাফা পাচ্ছি তাতে সংসার চলে না। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে ভেঙে ফেলাই ভালো। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনও বলছে একই কথা। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সঞ্চয়পত্রে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে, তার চেয়ে ৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা বেশি গ্রাহককে পুরনো দায় হিসেবে ফেরত দিতে হয়েছে সরকারকে। গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রে সরকারের দায় ছিল ১ হাজার ৬১০ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ নিট ঋণাত্মক বিক্রি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল গ্রাহকদের পরিশোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমেছে। এ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নিয়মকানুনও যুক্ত হয়েছে। আগে সঞ্চয়পত্র কিনতে শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) দিলেই হতো, এখন আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সনদও জমা দিতে হচ্ছে। তো যাদের টিআইএন আছে, ট্যাক্স রিটার্ন দেন না, তাদের কাছে আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করছে না সরকার। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত নভেম্বর পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেশি পরিমাণে বাড়ছিল। এতে সরকারের সুদ পরিশোধের ব্যয়ও অনেক বেশি বেড়ে যায়। বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎস করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার পরও বাড়তে থাকে বিক্রি।