সোমবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

গৃহকর্মীদের ওপর বেড়েছে বর্বরতা

জিন্নাতুন নূর

সামান্য ত্রুটি পেলেই গৃহকর্ত্রী বা গৃহকর্তারা তাদের ওপর চালান অকথ্য নির্যাতন। প্রতিনিয়ত তাদের ওপর চলে চড়-থাপ্পড়, লাথি-ঘুসি। দিন-রাত অমানবিকভাবে কাজ করিয়ে নিয়ে তাদের পর্যাপ্ত খাবার খেতে ও বিশ্রাম নিতে দেওয়া হয় না। গায়ে গরম খুন্তি, জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা, চিমটি দিয়ে গায়ের মাংস তুলে নেওয়া, মাথা  ফাটিয়ে ও হাত-পা ভেঙে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। এ ছাড়া মাথার চুল কেটে দেওয়া, গরম পানি দিয়ে শরীর ঝলসে দেওয়া, ঘরবন্দি করে রাখা এবং ধর্ষণ করার মতো নির্যাতনের শিকার হতে হয় গৃহকর্মীদের। অথচ দেশে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা থাকলেও গৃহকর্মী নির্যাতন থেমে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারহীনতার কারণেই দোষীরা বারবার গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের সাহস পাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে, ২০২৩ সালের ১২ মাসে মোট আটজন গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। এর মধ্যে সাত থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু গৃহকর্মী পাঁচজন আর ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী দুজন। একজনের বয়স জানা যায়নি। ২০২৩ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মোট সাতজন গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়। আর রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় চারজনের।

এ পরিসংখ্যান নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যার সঙ্গে সাজুয্য নয়। কারণ গৃহকর্মীদের নির্যাতনের সব ঘটনা সবসময় সামনে আসে না। কারণ গৃহকর্মী বা তাদের পরিবারের সদস্যরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে মামলা করতে চান না বা সাহস পান না। আবার প্রভাবশালীরা অনেক নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে ফেলেন। গত বছরের ডিসেম্বরের ২ তারিখে রাজধানীর হাতিরপুলে গুরুতর জখম এক গৃহকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। নাজমা খাতুন (১৬) নামের এই গৃহকর্মীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। পুলিশ ধারণা করছে, নাজমা যে ভবনে কাজ করত সে ভবনের অষ্টম তলা থেকে সে পড়ে গেছে বা লাফ দিয়েছে। এর আগে গত বছর ২৬ আগস্ট কলাবাগান থেকে মোছা. হেনা নামের এক শিশু গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এতিম হেনাকে গৃহকর্ত্রী সাথী তিন বছর আগে ঢাকায় নিয়ে আসেন। শিশুটিকে নির্যাতন করে হত্যার পর সাথী পালিয়ে যান। পরে পুলিশ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দরজা ভেঙে হেনার লাশ উদ্ধার করে। পুলিশের ধারণা, বাসাটিতে ১০ বছরের এই গৃহকর্মীকে প্রায়ই নির্যাতন করা হতো। হেনার লাশ উদ্ধারের পর সুরতহালে পুলিশ দেখতে পায়, শরীরে অনেক নতুন ও পুরনো আঘাতের চিহ্ন। মুখে ফেনা এবং শরীর ফোলা। গত বছরের ৩ জুলাই সিলেটে এক নার্স দম্পতির বিরুদ্ধে ভাত বেশি খাওয়ায় গৃহকর্মীকে রান্নার কাজে ব্যবহৃত স্টিলের খুন্তি আগুনে গরম করে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এতে নগরীর কোতোয়ালি থানায় ভুক্তভোগীর বাবা বাদী হয়ে মামলা করেন। এ ছাড়া গত বছর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পালাতে গিয়ে উঁচু ভবন থেকে পড়ে কয়েকজন শিশু গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শুধু শারীরিক বা মানসিকভাবেই নয়, কোনো কোনো গৃহকর্মীকে যৌন নির্যাতনেরও শিকার হতে হচ্ছে। গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা এবং অক্সফাম ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় সুনীতি প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ৪২ শতাংশ আবাসিক গৃহকর্মী বসার ঘর বা রান্নাঘর ও বারান্দার মতো খোলা জায়গায় ঘুমান। আর আবাসিক গৃহকর্মীরা দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। ৮০ শতাংশ খ কালীন গৃহকর্মী কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পান না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ অ্যান্ড ডিনেটের আরেক জরিপে জানা যায়, গৃহকর্মীদের ৪ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। শারীরিক নির্যাতন শিকার ২১ শতাংশ, মানসিক নির্যাতনের শিকার  ৬৭ শতাংশ এবং মৌখিক নির্যাতনের শিকার ৬১ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ বাস্তবায়ন না হওয়ায় একের পর এক গৃহকর্মীর মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বিচারহীনতার কারণে দোষীরা বারবার গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের সাহস পাচ্ছে। এসব ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে সেই ভয়ে আর কেউ গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতন করবে না। তাদের মতে, প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ড কমিশনার কার্যালয়ে গৃহকর্মীদের নিবন্ধন চালু করা জরুরি, যাতে প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকার পর্যায় থেকে দুর্যোগকালীন তাদের সহায়তার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে দ্রুত যোগাযাগ করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ থাকলেও এর বাস্তবায়ন নেই। গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধে নির্যাতনকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে সুবিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি সরকারের কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর