রবিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

একই স্পটে বারবার ছিনতাই

♦ রহস্যজনক নীরবতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ♦ গত বছর ডিএমপিতে দস্যুতা ও ডাকাতির মামলা ২৩৩টি, কেবল ছিনতাই-দস্যুতার ঘটনা ১৯৯টি

সাখাওয়াত কাওসার

একই স্পটে বারবার ছিনতাই

গত ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিট। রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে নিজ বাড়ি হবিগঞ্জ যাচ্ছিলেন জনাব আলী সরকারি কলেজের শিক্ষক মাহমুদ মিয়া। তার বাসটি যাত্রা শুরু করেছে বিষয়টি স্ত্রীকে অবহিত করতে পকেট থেকে সেলফোন বের করেন। তার বাসটি ততক্ষণে জনপথ মোড় এবং যাত্রাবাড়ী থানার মাঝামাঝি অবস্থানে। তবে কথা শুরু করার আগেই ছিনতাইকারীরা রীতিমতো বাজপাখির মতো তার হাতে থাকা ‘রেডমি নোট-১১’ ব্র্র্যান্ডের ফোনটি ছিনিয়ে নেয়। কোনো কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না মাহমুদ ও তার পাশের সিটে থাকা যাত্রীরা। মনকে সান্ত্বনা দিতে বাস থেকে নেমে মাহমুদ ও আরও কয়েকজন যাত্রী কিছুদূর এগিয়ে ছিনতাইকারীকে খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় পরদিন বানিয়াচং থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর-১২১১) করেন। তবে গতকাল পর্যন্ত ছিনতাই হওয়া ফোনটি উদ্ধার হয়নি। এ ঘটনার মাত্র এক দিন পর ২৭ নভেম্বর একই জায়গা থেকে রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঠিক একই কায়দায় নিজের ‘সামস্যাং এ-৭৩’ ব্র্যান্ডের সেলফোন খোয়ান আবদুল মমিন ডিরো নামের এক ব্যক্তি। তিনিও সায়েদাবাদ থেকে বাসে করে ঢাকার বাইরে যাচ্ছিলেন। এক সপ্তাহ ধরে ওই এলাকায় কাজ করেন এই প্রতিবেদক। তার চোখের সামনেই ঘটেছে অন্তত পাঁচটি ঘটনা। এগুলোর একটিতে দেখা গেছে, সিএনজি অটোরিকশার পেছনের প্লাস্টিকের ঢাকনা কেটে যাত্রীর কানের দুুলও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে এসব ঘটনার ভুক্তভোগীরা বাসের যাত্রী হওয়ায় তাদের আর বাস থেকে নেমে গিয়ে সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে নাজমুল হোসেন নভেল নামের ভুক্তভোগী একজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তার সেলফোনও ছিনতাই হয়েছে। তিনিও সায়েদাবাদ থেকে সিলেট যাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, আসলে আমি নিজে ভাই একজন চাকরিজীবী। ছিনতাইয়ের মামলা করলে আদালতে যাবে কে? অফিস কি ছুটি দেবে? সঙ্গে পুলিশি ঝামেলা। খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশি ভাই!!!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী এলাকায় অন্তত তিনটি চক্র কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। একেকটি গ্রুপের দলনেতা কানা মিজান, টুক্কা আজিজ এবং ল্যাংড়া ইকবাল। চক্রের সদস্যদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। নেশার টাকা জোগাতে নিয়ম করে ছিনতাই করে থাকে। তাদের বিভিন্ন বিষয় দেখভাল করে বুলেট আজিজ নামের একজন। সে নিজেও এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। কথিত রয়েছে সে যাত্রাবাড়ী থানার সোর্স হিসেবে কাজ করে। ধূপখোলা মাঠ এলাকায় বিচরণ বুলেট আজিজের। তার পেছনেও রয়েছেন এলাকার কয়েকজন ক্ষমতাসীন ব্যক্তি এবং যাত্রাবাড়ী থানার কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য। র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও কাজ করছে। তবে দেখা গেছে ছিনতাইয়ে জড়িত বেশির ভাগই হেরোইন, গাঁজা এবং ড্যান্ডিতে আসক্ত। তাদের বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও বিব্রত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের গ্রেফতারের পর হাজতখানায় বমি করছে। চিৎকার চেঁচামেচি করছে। অনেকের বয়সই ১৮-এর কম। তাহলে কি ঘটনা ঘটতেই থাকবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভাসমান লোকজনদের রাজধানী থেকে সরানো সম্ভব না হলে এসব ঘটনা ঠেকানো খুব কঠিন। যাত্রীদেরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা এয়ারপোর্ট, আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ড, আজমপুর বাসস্ট্যান্ড, কুড়িল বিশ্বরোড, ৩০০ ফিট, মতিঝিল ব্যাংকপাড়া, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও, বাসাবো, কমলাপুর, শাহবাগ, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকার বেশ কয়টি এলাকায় নিয়মিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এসব এলাকায় চলন্ত সিএনজি অটোরিকশার পেছন দিকের ঢাকনা কেটে যাত্রীদের কানের দুল, গলার চেইনসহ মূল্যবান সরঞ্জামাদি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা অহরহ। গত ২২ ডিসেম্বর বেলা দেড়টার দিকে গুলিস্তানে সোনিয়া আক্তার (৩২) নামে এক নারীর কানের সোনার দুল ছিনিয়ে নেয় রুবেল (২৫) নামের এক ছিনতাইকারী। তবে দৌড়ে পালানোর সময় কয়েকজন পথচারী তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলার পর সেই দুল গিলে ফেলে রুবেল। পরে তাকে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়। অনুসন্ধান বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত স্পটগুলোতে সক্রিয় ছিনতাইকারীদের সংশ্লিষ্ট থানার পরিচিত মুখ। এরাই ঘুরেফিরে ওই এলাকায় ছিনতাইয়ে লিপ্ত হচ্ছে। কোনোভাবেই কমিয়ে আনতে পারছে না সংঘবদ্ধ ছিনতাইয়ের ঘটনা। আবার ভুক্তভোগীদের অনেকেই উল্টো পুলিশি ঝামেলার আশঙ্কায় থানায় যেতেও চান না। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার মহিদ উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে আমরা গত এক বছরে ডিএমপির বিভিন্ন এলাকা থেকে ১ হাজারের বেশি ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছি। তারা জামিনে বের হয়ে পুনরায় একই কাজে জড়াচ্ছে। তবে আমাদের তৎপরতা কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি অন্য কোনোভাবে কমিয়ে আনা যায় কি না সে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর রাজধানীতে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। তবে ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ রেকর্ড না করায় এই প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ছিনতাইয়ের পর ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করায় অপরাধীরাও থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। চুরি ও ছিনতাইয়ের বড় কোনো ঘটনা না ঘটলে বিষয়গুলো সামনেও আসে না। পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর ডিএমপির ৮টি ক্রাইম বিভাগের ৫০ থানায় দস্যুতা ও ডাকাতির মামলা হয়েছে ২৩৩টি। এর মধ্যে ছিনতাই-দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে মোট ১৯৯টি। ডাকাতির মামলা হয়েছে ৩৪টি। এর মধ্যে রমনা বিভাগে ২৮টি, ওয়ারী বিভাগে ৩৬টি, লালবাগে ২৩টি, মতিঝিলে ৩৪টি, মিরপুরে ১৯টি, গুলশানে ১৮টি, উত্তরায় ২১টি এবং তেজগাঁওয়ে ৬৫টি মামলা করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতি মাসে অর্ধশতাধিক ছিনতাইয়ের শিকার লোকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয়। র‌্যাব জানায়, ২০২৩ সালে রাজধানীর ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ৬৩৪ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। ডিএমপি সূত্র জানায়, গত বছর সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অপরাধীদের তথ্যভান্ডার গড়ে তোলে ডিএমপি। তাতে রাজধানীতে ছিনতাইয়ে ১ হাজার ৭৩৭ জন যুক্ত থাকার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী, ডাকাত ও অপহরণকারী পুলিশের তেজগাঁও বিভাগে।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর