রাজধানীর উত্তরায় দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ কোকেনের চালান জব্দের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে নানা দফতরে। নড়েচড়ে বসেছেন দায়িত্বশীলদের অনেকেই। ফের উঠে এসেছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণেই এখনো বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ভীষণ পছন্দ আন্তর্জাতিক চোরাচালান মাফিয়াদের। এ কারণে গত পাঁচ বছরে অন্তত ১৫টি কোকেনের বড় চালান বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে মাদক মাফিয়ারা। সীমান্ত পার হয়ে মাদকের এসব চালানের গন্তব্য ছিল পার্শ্ববর্তী দেশ। কোকেন কাণ্ডে সর্বশেষ সাতজন গ্রেফতার হলেও আরও অন্তত পাঁচ দেশি-বিদেশি নাগরিক নজরদারিতে রয়েছেন। যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে তাদের সম্পর্কে প্রাপ্ত নানা তথ্য-উপাত্ত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশন) তানভীর মমতাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা মাত্র শুরু। আমরা সামর্থ্যরে পুরোটাই দেওয়ার চেষ্টা করছি। এর বাইরে এখন কোনো মন্তব্য নয়। জানা গেছে, গত ২৪ জানুয়ারি উত্তরা থেকে দুই দফায় সাড়ে আট কেজি কোকেন উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতার বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অবহিত করা হয়েছে পুলিশ সদর দফতরে থাকা আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থার বাংলাদেশ শাখা ‘এনসিবি (ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো) ঢাকা’র মাধ্যমে। কোকেনের চালানগুলো কোন কোন দেশ হয়ে বাংলাদেশে এসেছে সেই দেশগুলোর এনসিবিকে অবহিত করতে এনসিবি, ঢাকার মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর সূত্র। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গ্রেফতারদের আর্থিক লেনদেনের ইতোমধ্যে নানা প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বাইরে প্রযুক্তির সহায়তা এবং গ্রেফতারদের জবানিতে অনেকের নাম উঠে এসেছে। এখন তাদের গতিবিধি, আর্থিক লেনদেন, কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষায়িত ইউনিট ‘বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’-এর (বিএফআইইউ) সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে নাইজেরিয়ায় অবস্থানরত আন্তর্জাতিক মাফিয়া জ্যাকব ফ্রাংকির নির্দেশেই বিভিন্ন সময় মাদক বহনকারীরা বাংলাদেশে এসেছিলেন। সবশেষ অন এরাইভাল ভিসায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চালান নিয়ে এসেছিলেন মালাউয়ের নাগরিক নোমথানডাজো তোয়েরা সোকো, ক্যামেরুনের নাগরিক কেলভিন ইয়েংগি এবং তানজানিয়ার নাগরিক মোহাম্মদী আলী মোহাম্মদ। আগেও তারা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে এসে মিশন সম্পন্ন করে নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। গার্মেন্ট ব্যবসার আড়ালে ফ্রাংকির ভয়ংকর এই কাজের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তার নিজের ভাই উইসি। বাংলাদেশের সীমান্তে এবং সীমান্তের ওপারে চক্রটির নিজেদের লোক রয়েছে। এ কারণে কোকেনের চালান জব্দ হওয়ার পরপরই সীমান্ত পার হয়ে উইসি পার্শ্ববর্তী দেশে চলে গিয়েছেন।মাদক উদ্ধার নিয়ে কাজ করেছেন বিভিন্ন সংস্থার এমন অনেক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, কেবল সোকো কিংবা কেলভিন নয় আরও অনেকেই হয়তো বহনকারী হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিল। আবার ফ্রাংকির বাইরেও হয়তো আরও আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
জানা গেছে, গত বছরের ২৭ আগস্ট কেলভিন ইয়েংগি (৪২) অন এরাইভাল ভিসায় কাতারের দোহা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন। মিশন সম্পন্ন করে তিনি ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছাড়েন। এর পর ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আসেন নোমথানডাজো তোয়েরা সোকো। এক সপ্তাহ অবস্থানের পর তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। সোকে মালাউয়ের একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করেন। হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে মাদক বহনের কাজটি করে আসছেন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। তার স্বামী মালাউ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগে কাজ করেন। তবে কোকেন সংশ্লিষ্টতায় গ্রেফতার তানজানিয়ার নাগরিক মোহাম্মদী আলী মোহাম্মদের বাংলাদেশে এর আগে প্রবেশের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক (ডিজি) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী সাংবাদিকদের বলেছেন, এই চক্রের বিষয়ে তারা আরও খোঁজখবর নিচ্ছেন। তবে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক এই চক্রের প্রধান হলেন ডন ফ্রাংকি। নয় মাস আগে তিনি বাংলাদেশ ছাড়লেও নাইজেরিয়ায় বসেই মাদক ব্যবসার সমন্বয় করছেন। সূত্র বলছে, ফ্রাংকির বারিধারার অফিসের ম্যানেজার আসাদুজ্জামান আপেল গার্মেন্ট ব্যবসার আড়ালে কোকেনের পুনঃপ্যাকেজিং, নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করতেন। দেশের বাইরে থেকে যারা আসতেন তাদের দেখাশোনার ভার ছিল তার ওপর। আপেল গ্রেফতার সাইফুল ইসলাম রনির সঙ্গে যোগাযোগ করে তার মাধ্যমে অস্তিত্বহীন কোম্পানির ভুয়া ইনভাইটেশন লেটার সংগ্রহ করতেন কোকেন বহনকারীদের জন্য।
ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেফতার রনি একটি এগ্রো মেশিনারিজ কোম্পানির পরিচালক। সঙ্গে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। তিনি ফ্রাংকির সঙ্গে গত দুই বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তার কাজ ছিল মাদক বহনকারীদের দেশে প্রবেশের প্রয়োজনীয় ইনভাইটেশন, হোটেল রিজার্ভেশন ও ভিসাপ্রাপ্তির কার্যক্রম তদারকি করা। রনি ‘মাসপেক্স লি.’ নামের একটি অস্তিত্বহীন কোম্পানির ভুয়া ইনভাইটেশন লেটার তৈরি করে ফ্রাংকির কাছে পাঠাত। তবে ফ্রাংকির সহযোগী আরও অনেকেই রয়েছে। তাদের বিষয়ে তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিএনসির পরিদর্শক দেওয়ান মো. জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে আমরা বেশকিছু তথ্য পেয়েছি। বর্তমানে এগুলোর যাচাই-বাছাই চলছে। তবে গ্রেফতারদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে তাদের প্রত্যাশা।
তিনি আরও বলেন, সোকোর জন্য ১০ দিন এবং বাকিদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে আদালতে। বুধবার (আজ) আদালত আদেশ দিলেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হবে।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার আফ্রিকার দেশ মালাউইর নাগরিক নোমথানডাজো তোয়েরা সোকো (৩৫) নামের এক নারীকে আট কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেনসহ গ্রেফতার করা হয় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। পরদিন বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি হোটেলে অভিযান চলাকালে আর্মড পুলিশের একটি কুকুর তানজানিয়ার নাগরিক মোহাম্মদী আলী মোহাম্মদের কাছে মাদক শনাক্ত করে। পরে তাকে ২০০ গ্রাম কোকেনসহ গ্রেফতার করা হয়। সবশেষ এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে আরও পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিএনসি।