রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজধানী নেপিডোতে চোখ বিদ্রোহীদের

মিয়ানমারে প্রতিদিনই বাড়ছে যুদ্ধের তীব্রতা, রাখাইনের মূল কেন্দ্রে অবরুদ্ধ জান্তা সেনাদের তাণ্ডব কারফিউ জারি, জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর, বাংলাদেশে সিএনজি অটোরিকশায় লাগল গুলি

প্রতিদিন ডেস্ক

রাজধানী নেপিডোতে চোখ বিদ্রোহীদের

বাংলাদেশের তুমব্রু সীমান্তে সড়কে অটোরিকশায় গুলি লাগে

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পতন ঘটাতে সব বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য এখন রাজধানী নেপিডো। মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী দল ও গোষ্ঠীগুলোও এজন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে সায় মেলাতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে, জান্তা সরকারের পতন ঘনিয়ে এসেছে। যে কোনো সময় এ রকম কিছু ঘটে যেতে পারে। এদিকে সবচেয়ে জোরদার লড়াই চলতে থাকা রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনী কোণঠাসা হয়ে রাজধানী সিত্তেতে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। কার্যত তারা চারদিক থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় রয়েছে। সর্বশেষ খবরে গতকাল জানা গেছে, অবরুদ্ধ জান্তা সেনারা সিত্তেতে কারফিউ জারি করেছে এবং ইন্টারনেটসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি ক্রুদ্ধ সেনারা আশপাশের গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ জন্য তারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর।

রাখাইনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম নারিনজারা নিউজ জানিয়েছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকার রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তেতে কারফিউ জারি করেছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কারফিউ থাকবে। সিত্তের এক বাসিন্দা নারিনজারা নিউজকে বলেছেন, ‘জান্তা প্রশাসন শহরে ছোট বাহনে করে ঘুরে ঘুরে লাউড স্পিকার এবং হ্যান্ড মাইকে কারফিউয়ের ঘোষণা দিয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যারা রাতে বাইরে বের হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বিদ্রোহীরা জানিয়েছে, অভিযান চালিয়ে দুটি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। গ্রাম দুটির প্রতিটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামবাসী জানিয়েছে, পুলিশ প্রায় ১০০টি কামানের গোলা নিক্ষেপ করেছে, যার বেশির ভাগই সার কোন পোতে, আইং দিন এবং তান খো গ্রামে পড়ে। আগুনে পুড়ছে পাকতাও, রামরি এবং মরাউক-উ উপশহরও। এসব অগ্নিকাণ্ডের কারণে রাখাইনের প্রায় ৩ লাখ বাসিন্দা নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবা। ফলে হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ জানা যাচ্ছে না। আরেকটি স্থানীয় গণমাধ্যম মিয়ানমার নাও-এক প্রতিবেদনে বলেছে, গৃহযুদ্ধে উত্তাল মিয়ানমার। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অভিযানে একের পর এক এলাকা হারাচ্ছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে জান্তা সেনারা। তারা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচার বিমান হামলার পাশাপাশি সেই পুরনো কৌশল ব্যবহার করছে। গ্রামে গ্রামে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এতে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে বাড়ির পর বাড়ি। খাক হচ্ছে মানুষ।

চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সাগাইংয়ের খিন-উ উপশহরের একটি গ্রামে অভিযান চালায় জান্তা সেনারা। এ সময় গ্রামের বাড়ি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। অভিযানের দুই দিন পর গত ১ ফেব্রুয়ারি ওই গ্রাম থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনের মাথা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। গত ২ ফেব্রুয়ারি এ তথ্য নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী খিন-উ পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)।

পৃথক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২ ফেব্রুয়ারি রাখাইন রাজ্যে জান্তার আরও একটি ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)। বিদ্রোহী বাহিনী ও জান্তা সেনার মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। সিত্তের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা এখন নিয়মিত রাতের বেলা গোলাগুলি এবং সেনাবাহিনীর বিমান ওঠা-নামার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে এ রাজ্যের সাধারণ মানুষের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে সেনারা। এদিন রাখাইনের পোন্নাগিউন উপশহরের একটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও এ ঘটনায় জান্তা কর্তৃপক্ষ মিলিটারি কাউন্সিল বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর দায় চাপিয়েছে।

আরেক খবরে বলা হয়েছে, এত দিন রাখাইনের রাজধানী সিত্তের আশপাশে লড়াই চলছিল। তবে এখন এটি সিত্তেতেই পৌঁছে গেছে। সামরিক জান্তার সেনারা বর্তমানে ইয়ো কায়া ব্রিজের নিচে এবং সাউথ কোরিয়া পোর্ট ব্রিজের কাছে অবস্থান নিয়ে আছে। আরাকান আর্মি জানিয়েছে, ম্রাউক-উ টাউনশিপে বেশ কয়েক দিন লড়াইয়ের পর লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন (এলআইবি) ৫৪০-কে তারা পরাজিত করেছে। সেখানে এলআইবি ৩৭৭ ও ৭৭৮ ব্যাটালিয়নের অন্তর্গত ঘাঁটিগুলোও ঘেরাও করেছে তারা। এএ আরও জানায়, গত ৩০ জানুয়ারি রাত ১২টার দিকে এলআইবি-৫৪০-এর সদর দফতরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। তারা এখন টাউনশিপের অবশিষ্ট দুটি সামরিক ঘাঁটি এবং অন্যান্য জান্তা ফাঁড়িকে লক্ষ্যবস্তু করছে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৭ অক্টোবর থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরুর পর থেকে এই জাতিগত জোট উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের বেশির ভাগ অংশ দখলে নিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ২০টি শহর এবং চীনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ। আরাকান আর্মি থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য। এই অ্যালায়েন্সে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মিও (টিএনএলএ) রয়েছে। এদিকে আল জাজিরা এবং কয়েকটি পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারে তিন বছর পূর্ণ করল সবশেষ সেনাশাসন। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে জান্তা সরকার। গণতন্ত্রপন্থি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো একের পর এক অঞ্চল দখল করে ক্রমেই রাজধানী নেপিডোর দিকে এগোচ্ছে। যে কোনো সময় পতন হতে পারে স্বৈরশাসনের।

কক্সবাজার প্রতিনিধির খবর : নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে এলোপাতাড়ি গোলাগুলি ও মর্টার শেল বর্ষণে প্রকম্পিত হচ্ছে এপারের বেশ কয়েকটি গ্রাম। গতকালও আতঙ্কে লোকজন নিরাপদে আশ্রয় নেয়। গোলাগুলির এক পর্যায়ে ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে সড়কে সিএনজি গাড়িতে এসে পড়ে মিয়ানমারের থেকে ছোড়া বুলেট। এতে ওই সিএনজির সামনের গ্লাস ফেটে যায়। তবে অক্ষত আছেন সিএনজি অটোরিকশার চালক। বিকাল ৩টার দিকে এই ঘটনা ঘটে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, সীমান্তের ওপারে রাখাইনের তুমব্রু রাইট পিলার ক্যাম্প এলাকা থেকে এলোপাতাড়ি ফায়ারিং শুরু হয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এই ফায়ারিং অব্যাহত ছিল। এর মধ্যে অন্তত ১০টি মর্টারশেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। গুলিবিনিময় হয়েছে দুই শতাধিক। এ সময় উখিয়ার বালুখালী থেকে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদে যাচ্ছিল একটি সিএনজি অটোরিকশা। এটি উত্তরপাড়া পৌঁছার পর সেখানে দাঁড় করিয়ে চালক আবু তাহের পান কিনতে দোকানে যান। এ সময় হঠাৎ তার সিএনজির সামনের গ্লাসে একটি বুলেট এসে পড়ে। ওই বুলেটের আঘাতে গ্লাস ফেটে যায়। সিএনজি চালক আবু তাহেরের বাড়ি ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রুতে। তিনি জানান, পান কিনতে যাওয়ার কারণে অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন তিনি। সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র বলছে, মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা বাহিনীর প্রায় সব ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। সীমান্তের ওই এলাকায় এখন মাত্র তিনটি ক্যাম্প দখলে আছে জান্তা বাহিনীর। এগুলো হলো তুমব্রু ৩৪ পিলার রাইট ক্যাম্প, ঢেকিবুনিয়া ক্যাম্প এবং আরেকটির নাম জানা যায়নি। এই ক্যাম্পগুলো দখলে নেওয়ার জন্য হামলা শুরু করেছে আরাকান আর্মি। স্থানীয়রা বলছেন, এই ক্যাম্পগুলোর অবস্থান সীমান্ত ঘেঁষা। ক্যাম্পগুলোর এপারের সীমান্তে প্রচুর বাংলাদেশি জনবসতি রয়েছে।

ক্যাম্পগুলো দখলের জন্য গোলাগুলি হলেই এপারের সীমান্তে চলে আসবে। হতাহতের ঘটনাও ঘটবে। যেটা ঘটেছে গতকাল দুপুরে।

সতর্ক অবস্থানে আছে কোস্ট গার্ড : মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের নবনিযুক্ত মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল মীর এরশাদ আলী বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে উত্তেজনা চলমান রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমরা কারও সঙ্গে বৈরিতা না করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করে চলতে চাই। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে চলমান যে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, তাতে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। বিশেষ করে পূর্ব সীমান্তে কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে, জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিষয়টি আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি। আমাদের সামুদ্রিক যে নিরাপত্তা রয়েছে, তার কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দেব না, এ ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

আমাদের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে নবনিযুক্ত মহাপরিচালক এসব কথা বলেন। তিনি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী মানবতা দেখিয়ে অনেক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আমাদের বর্তমান অবস্থান হচ্ছে মূল সমস্যাটা সমাধান করতে হবে। আমরা মনে করি রোহিঙ্গা পুশইন বা পুশআউট কোনো সমাধান নয়, একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান দরকার। এটা তাদেরই (মিয়ারমার) করতে হবে। আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা আর কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে চাই না। নতুন করে আর যেন কোনো রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ না ঘটে সে ব্যাপারে আমরা সবসময় সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।

সর্বশেষ খবর