ঢাকার বিষাক্ত বাতাসের চরম মাশুল দিচ্ছে নগরবাসী। শীত মৌসুম এলে প্রতিবারই ঢাকার বাতাস ভয়াবহ রকমের অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। শীত চলে গেলেও এবার শীতের দূষিত বায়ুর কারণে কাশি, শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে ভুগে মানুষজন চিকিৎসকদের কাছে বেশি যাচ্ছেন। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ভুগতে হচ্ছে বেশি। চিকিৎসকরা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর বাতাসের কারণে সর্দি-কাশি, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, বিষণ্নতা, নিউমোনিয়া ও ফুসফুস ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। তারা সুস্থ থাকতে বিনা প্রয়োজনে শিশু ও বয়স্কদের ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সব বয়সীদের বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরতে বলেছেন। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের সূচক অনুযায়ী, ঢাকার বাতাস বছরের অধিকাংশ সময়ই অস্বাস্থ্যকর থাকে। আর শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে যখন বাতাসের দূষিত পদার্থ প্রবেশ করে তখন ফুসফুস বেশি আক্রান্ত হয়। দূষণের কারণে দীর্ঘমেয়াদি রোগের আশঙ্কাও থাকে। প্রথমে সর্দি-কাশি দিয়ে শুরু হলেও একটা সময়ে গিয়ে রোগীদের ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লিভার ও কিডনিও। পরিবেশবিদ ড. আতিক রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বায়ুদূষণ বলতে এখন যা দেখতে পাচ্ছি সেটি আসলে ধুলো এবং অতি ক্ষুদ্র কণা, যা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। শহরে যে ধুলো উড়ে বেড়াচ্ছে তা বৃষ্টি বা পানির মাধ্যমে সরানোর কোনো উপায় নেই। ঢাকার আশপাশে আমাদের নদীগুলোও ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। এর ফলে ধুলো আটকানোর মতো কোনো ব্যবস্থাও এখন নেই। এতে বায়ুদূষণ বেড়েই চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে, বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বেড়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশি মানুষের গড় আয়ু কমেছে সাত বছর। এতে ঢাকাবাসীর গড় আয়ু কমছে আট বছর করে।
রাজধানীর শ্যামলীর বাসিন্দা নাজনীন আহমেদ সম্প্রতি ঢাকা শিশু হাসপাতালে তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান আইয়ানকে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসক দেখাতে। তিনি জানান, প্রায় মাসখানেক ধরে তার বাচ্চা সর্দি-কাশিতে ভুগছে। রাতে ঘুমের মধ্যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। চিকিৎসক বাচ্চাটির এক্স-রে রিপোর্ট দেখার পর তাকে জানান যে, দূষিত বায়ুর কারণে শিশুটির শ্বাসতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চিকিৎসক বাচ্চাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন।ধানমন্ডির বাসিন্দা আবদুল আলীম গত ফেব্রুয়ারি থেকে টানা শুষ্ক কাশিতে ভুগছেন। এর মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন করলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। আবদুল আলীমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে চিকিৎসক জানান, বায়ুদূষণের কারণে তার স্বাস্থ্যের এই অবনতি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে আছে হাঁচি, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। এ জন্য নতুন করেও অনেকে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার ধূলিকণার মধ্যে অনেক জীবাণু মিশে থাকে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন এবং শিশু-বয়স্কদের নিউমোনিয়া হচ্ছে। বায়ুদূষণের জন্য মানবস্বাস্থ্য নিয়ে চিকিৎসকরা অবশ্যই শঙ্কায় আছি। তবে দূষণ কমানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু ও বয়স্করা খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যেন না যায়। ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই সব বয়সীকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে এবং ইনফøুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার টিকা নিতে হবে। পরিমিত বিশ্রাম ও কিছু শারীরিক ব্যায়াম চর্চা করতে হবে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
বিশ্বব্যাংকের ‘ব্রিদিং হেভি : নিউ ইভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে বছরে প্রায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ কারণে শ্বাসকষ্ট, কাশি, নিম্ন শ্বাসনালি সংক্রমণ এবং বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়ছে। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক এবং সহজাত রোগে আক্রান্তদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও শ্বাসযন্ত্রের অবস্থা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে শিশু ও বয়স্কদের পাশাপাশি সব বয়সী মানুষের চিকিৎসা নেওয়ার হার গত কয়েক বছরে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। পৃথিবীতে আসার আগেই দূষিত বাতাসের শিকার হচ্ছে গর্ভজাত শিশু। এ দূষণের কারণে মায়েদের কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার বেশি। আবার অটিজমে আক্রান্ত শিশুর জন্ম নেওয়ার কারণও বায়ুদূষণ। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর এক গবেষণা বলছে, ঢাকায় সন্তানসম্ভবা মায়েদের ওপর বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জন্ম নেওয়া ৩ হাজার ২০৬টি নবজাতককে নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার বেশি। অকালে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি।