রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

ডিজিটাল জরিপে হাঁস-মুরগি গবাদি পশু

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার ইয়ারপুর ইউনিয়নের পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা একটি গ্রাম তৈয়বপুর। জিরাবো বাসস্ট্যান্ড থেকে ডানপাশে পিচঢালা পথ। এই পথের বাঁক ধরে কিছুটা এগোলেই কাঁচা রাস্তা চলে গেছে হিন্দুপাড়ার দিকে। এখানে বাড়িগুলো একটি অপরটির সঙ্গে লাগোয়া। কারও বাড়ির উঠান, কারও বাড়ির বাশঝাঁড়ের পাশ দিয়ে সরুপথ চলে গেছে ফসলের খেতের দিকে। সেই খেতে ফসল নেই, গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। তারই পাশে ছোট্ট একটি পাড়া। প্রথম বাড়িটিই কাননবালার।

বেশি ব্যবহারে রং জ্বলে যাওয়া তাঁত কাপড়ের আঁচলটি কোমরে গুঁজে গরুর খাবার দিচ্ছেন কাননবালা। এই প্রতিবেদকের দিকে চেয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন, ‘মাইনসের থন গরুর খাওনের দাম বেশি। খাওন দিতে পারি না, আগের মতো দুধও দেয় না...।’ গোয়ালে মোট ৯টি গরু। চারটি গাভি। বাকিগুলো ষাঁড়। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীনে তৈয়বপুর গ্রামে এই গবাদিপশুর তথ্য সংগ্রহ করছেন মিতা রায় নামে একজন মাঠকর্মী। সেই তথ্য ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় জমা হচ্ছে কম্পিউটার কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় ডাটা সেন্টারে।

মিতা রায় ইয়ারপুর ইউনিয়নের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)-এর লাইভস্টক সার্ভিস প্রোভাইডার (এলএসপি) জানান, তিনি তার এলাকার প্রায় ১ হাজার ৭০০ বাড়ির প্রতিটিতে ঘুরে ঘুরে- সেই বাড়ির গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া, ঘোড়া, শূকর, হাঁস-মুরগি, কোয়েল, টার্কি, তিতির, কবুতরসহ গৃহপালিত পশুপাখির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এই তথ্যগুলো মোবাইল ফোনে একটি ডিজিটাল ফরমেটে সন্নিবেশন করেছেন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই আবার সংগৃহীত তথ্যগুলো এলডিডিপির তৈরি করা সার্ভারে আপলোড করছেন। পুরো কাজটিই হচ্ছে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায়। শুধু সাভার নয়, সারা দেশের ৬১ জেলার (প্রকল্প এলাকা) প্রাণিসম্পদের এই তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ হচ্ছে বলে, এই উদ্যোগের নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রাণিসম্পদ হাউসহোল্ড ডিজিটাল জরিপ, ২০২৪’। চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি এই জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে তথ্য সংগ্রহের কাজ প্রায় শেষের পথে। বাকি আছে শুধু দেশের চার মেট্রোপলিটন এলাকার জরিপের কাজ।

যেভাবে চলছে ডিজিটাল জরিপ : ডিজিটাল জরিপের পুরো কার্যক্রমটি কেন্দ্র থেকে সমন্বয় করছেন এলডিডিপির চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী। তিনি তার দফতরে এই প্রতিবেদকের উপজেলার নাম জেনে, কম্পিউটারের লোকেশনে একটি ক্লিক করে মুহূর্তেই জানিয়ে দেন, ওই উপজেলার মোট প্রাণিসম্পদের সংখ্যা (জরিপের কাজ চলমান থাকায় সংখ্যাটি প্রকাশ করা হলো না)। ড. রব্বানি জানান, এলডিডিপি প্রকল্পে নিয়োজিত ১০ হাজারের বেশি কর্মী প্রতিদিন তথ্য সংগ্রহ করছেন। এ জন্য পৃথক কোনো জনবল দরকার পড়েনি। ফলে আলাদা কোনো ব্যয়ও হচ্ছে না। দৈনিক গড়ে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ খানার তথ্য জমা হচ্ছে। পরিসংখ্যানের দ্বৈততা (ডুপ্লিকেশন) এড়াতে সফটওয়্যারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যুক্ত করা হয়েছে। দৈনন্দিন কার্যক্রম পরীবিক্ষণের জন্য প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পে স্থাপিত হয়েছে নিয়ন্ত্রণকক্ষ। যাচাই-বাছাই শেষে সংগৃহীত তথ্য জমা হচ্ছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের তথ্য সার্ভারে। তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে কথা হয় গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ায় এলডিডিপি প্রকল্পের প্রাণিসম্পদ মাঠ সহকারী (এলএফও) মো. নাজমুলের সঙ্গে। তিনি জানান, শুধু গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির সংখ্যা নয়, এই ডিজিটাল জরিপের মাধ্যমে খামারির নাম, ঠিকানা, সেলফোন নম্বর- এমন কি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরও সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রাণির ক্ষেত্রে সংখ্যা ছাড়াও বয়স, লিঙ্গ, জাত (দেশি ও সংকর), খামারে দৈনিক মোট দুধ উৎপাদন, ডিমের উৎপাদন, সংখ্যা ও জাত, গবাদিপশুর জন্য সবুজ ঘাসের উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ, সেখান থেকে ঘাসের গড় উৎপাদন এসব তথ্যও নেওয়া হচ্ছে প্রতিটি খানা থেকে।

কেন এই ডিজিটাল জরিপ : এলডিডিপির প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুর রহিম বলেন, ‘যে কোনো পরিসংখ্যান প্রণয়নের আইনগত অধিকার ও দায়িত্ব বিবিএসর। তারা যে কৃষিশুমারি করে সেখানে একটি পরিবারে কয়টি গবাদিপশু, কয়টি হাঁস-মুরগি-এ তথ্য থাকে। ওই গরুগুলো কী পরিমাণ দুধ দেয়, কী ধরনের খাবার খায়, ওই খাবারের উৎস্য কী- এসব তথ্য মিলছে না। তথ্যের এই ঘাটতি পূরণ এবং আন্তসংস্থা তথ্যের পার্থক্য কমিয়ে আনতেই প্রাণিসম্পদ খাতে ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।’ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ‘আমাদের ভিত্তি যদি ঠিক না থাকে- তবে কোথায় সমস্যা, কোথায় সম্ভাবনা- তা চিহ্নিত করতে পারব না। এই ভিত্তি হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ পরিসংখ্যান। প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান থাকলে তা প্রাণিসম্পদ খাতে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, নীতিকৌশল প্রণয়ন, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ, গবেষণায় কাজে লাগবে; হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা যাবে; উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণে গ্রহণ করা যাবে নানা উদ্যোগ। ন্যায্যমূল্য পাবেন খামারিরা। এতে শুধু কাননবালার মতো খামারিদের ভাগ্য বদলে যাবে তাই নয়, পর্যাপ্ত তথ্য হাতের নাগালে পাওয়া গেলে এ খাতে নতুন বিনিয়োগও আসবে।’

 

সর্বশেষ খবর