বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

ভয় বাড়াচ্ছে বন্যা

প্রতিদিন ডেস্ক

ভয় বাড়াচ্ছে বন্যা

সুরমা নদীর পানি ঢুকে তলিয়েছে সিলেট নগরের তালতলা এলাকা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সিলেট ও উত্তরের কয়েক জেলায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ভারতের মেঘালয় ও আসামে অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেটের সবকটি নদনদীর পানি বাড়ছে। ইতোমধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশনের কিছু এলাকাসহ জেলার ১৩টি উপজেলার সবকটিতে বন্যা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জে নদী তীরবর্তী এলাকায় পানি কিছুটা কমলেও হাওরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পার্শ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজারে বন্যায় ২ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এদিকে কুড়িগ্রামের তিস্তা ও দুধকুমার নদের পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে নেত্রকোনায় বাড়ছে উব্দাখালী নদীর পানি। অপরদিকে, ভারী বৃষ্টিতে কক্সবাজারে টেকনাফে ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

সিলেট : সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ভারতের মেঘালয় ও আসামে অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেটের সবকটি নদনদীর পানি বাড়ছে। একই সঙ্গে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সিটি করপোরেশন এলাকার একাংশসহ জেলার ১৩টি উপজেলার সবকটিতে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী জেলায় প্রায় সোয়া ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। বন্যার্তদের জন্য জেলায় ৬৫৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সুরমা নদীর পানি ঢুকে নগরের বৃহৎ অংশ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। বরইকান্দি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বন্যার কবল থেকে রক্ষায় সেনাবাহিনী কাজ করছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান। এ ছাড়া নগরের তালতলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়সহ বেশ কয়েকটি জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে পানি ওঠায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্ন হচ্ছে। জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে ভারতের মেঘালয় ও আসামে টানা ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে সিলেট নগরসহ পুরো জেলাজুড়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার প্রধান নদীগুলোর প্রায় সবকটিই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নতুন করে প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারার পানি আমলসীদে ৬২ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে ১০০ সেন্টিমিটার ও শেরপুরে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শেওলা পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৪২ সেন্টিমিটার। এদিকে, ভারী বৃষ্টিতে সিলেট বিভাগে আরও ভূমি ধসের শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। গতকাল আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবাণীতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। এতে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে।

(বিশ্বনাথ) সিলেট : বিশ্বনাথ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন অর্ধশতাধিক পরিবার। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দি হয়েছেন উপজেলার লামাকাজি, খাজাঞ্চী, দশঘর ও দেওকলস ইউনিয়নের মানুষ। লামাকাজি ও খাজাঞ্চী ইউনিয়ন সুরমা নদীর পার্শ্ববর্তী হওয়ায় নদীর পানি তীর ডিঙিয়ে প্রবল বেগে প্রবেশ করছে এসব এলাকায়। প্লাবিত হয়েছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়। ডুবেছে পথঘাট। বন্যায় ভেসে গেছে মৎস্য খামার ও বসত বাড়ির পুকুরের মাছ। তলিয়ে গেছে আমনের বীতলা, ফল-ফসল ও সবজি খেত। গতকাল বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি। এ সময় তিনি পানিবন্দি মানুষের মধ্যে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করেন।

সুনামগঞ্জ : নতুন করে প্লাবিত হয়েছে দোয়ারাবাজার, ছাতক, সদর, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার বহু গ্রাম। সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে বন্ধ প্রায় সবগুলো উপজেলার সড়ক যোগাযোগ। তবে সুনামগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার এবং ছাতক পয়েন্টে ১৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া কুশিয়ারা যাদুকাটাসহ জেলার সবগুলো নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে, নদীর পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হওয়ায় ভাটিতে ক্রমেই বাড়ছে পানি। সুনামগঞ্জ জেলা সদরের কাজির পয়েন্ট, উকিলপাড়া, ষোলঘর পয়েন্ট, তেঘরিয়াঘাট, ষোলঘর পয়েন্ট, নবীনগর, সুলতানপুর, নতুনপাড়া এপাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। অনেক বাসাবাড়িতে ঢুকছে বানের পানি। বন্যার্তদের কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।

চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন তারা বানভাসি মানুষ। কেউ কেউ উঠেছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। জেলার সবগুলো স্কুলকলেজ বন্যার্থদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক রাশেদ ইকবাল চৌধুরী।

মৌলভীবাজার : টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে মৌলভীবাজার জেলাজুড়ে প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। গতকাল সকালে জেলা প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে কুলাউড়া, রাজনগর, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার ৫৭১টি পরিবারকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।

নেত্রকোনা : টানা কয়েকদিনের বর্ষণ এবং ভারতের মেঘালয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতে বাড়ছে নেত্রকোনার প্রধান প্রধান নদনদীর পানি। সীমান্ত উপজেলা পাহাড়ি নদী সোমশ্বেরী ভরে টইটম্বুর হয়ে গেলেও গতকাল বিকাল পর্যন্ত পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে কংশ ও ধনু নদের পানি বাড়তে থাকলেও বিপৎসীমার নিচে রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিঘণ্টার হালনাগাদ সূত্র নিশ্চিত করেছে।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নদনদীর পানি কমা-বাড়ার মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে বন্যা। কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে জেলার সবকটি নদনদীর পানি হুহু করে বাড়ছে। এখন তিস্তা ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। গতকাল বিকাল ৩টায় স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, দুধকুমার নদের পাটেশ্বরী পয়েন্টে পানি সামান্য কমে বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়াও ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানিও সকাল থেকে ক্রমেই দ্রুত বাড়ছে। এদিকে নদনদীর পানি বাড়ায় নদনদী অববাহিকার বেশ কিছু চর ও দ্বীপচরসহ নিম্নাঞ্চলসমূহ তলিয়ে গেছে। এসব চরের প্রায় কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেকেই উঁচু স্থানে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। এসব এলাকায় স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তলিয়ে গেছে শতাধিক হেক্টর জমির বাদাম, ভুট্টা ও পাটখেত। কৃষকরা অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

লালমনিরহাট : উজানের ঢল এবং ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ছুঁইছুঁই করছে। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তিস্তা ও সানিয়াজান নদীর পাড়ে বাসিন্দারা বন্যার আশঙ্কা করছেন। এদিকে চরে বসবাসরত ৫ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় জেলার পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, সিঙ্গামারী ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্ণা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ও সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কালমাটি, রাজপুর, গোকুন্ডা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করছে।

চর সিন্দুর্ণার মফিজার রহমান বলেন, গত রাত থেকে তিস্তা পানি বৃদ্ধি পেয়ে চর এলাকার বসতবাড়ি ও চলাচলের রাস্তা ডুবে গেছে। পরিবারগুলো ঘর থেকে বের হতে পাচ্ছে না।

রংপুর : তিস্তা নদীর পানির তোড়ে জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার রাতে সেখানে প্রায় ১০০ মিটার অংশে ভাঙন শুরু হয়।

কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, ইতোমধ্যে তিস্তা নদীর পানিতে চরের বাদাম ও পাটখেত তলিয়ে গেছে। শতাধিক পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

গাইবান্ধা : জেলার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়াসহ সবগুলো নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে বন্যার আশঙ্কায় রয়েছে স্থানীয়রা।

কক্সবাজার : ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে টেকনাফের ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম জানান, টেকনাফে গত ৬ ঘণ্টায় ৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানায়, টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের প্রায় ৮ গ্রাম, হ্নীলা ইউনিয়নের ১২ গ্রাম, টেকনাফ পৌরসভার ৭ গ্রাম, সদর ইউনিয়নের ৬ গ্রাম, সাবরাং ইউনিয়নের ১০ গ্রাম, বাহারছড়া ইউনিয়নের ৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ভারী বর্ষণের ফলে কিছু গ্রামে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আমরা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। সকালে সব জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করা হয়েছে স্লুইচ গেটগুলো খোলে দেওয়ার জন্য। পাশাপাশি ভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে। তাই সকাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে। এ জন্য আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর