ঈদুল আজহার ছুটিতে রাজধানীসহ সারা দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। রাজধানীর রমনা পার্ক, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রিমা উদ্যান, রবীন্দ্র সরোবর, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় সবাই আনন্দে সময় কাটিয়েছেন। নগরবাসীর জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো টগি ওয়ার্ল্ড থিম পার্ক। মানুষ একটু আনন্দে সময় কাটাতে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পারিবারিক বিনোদনের কমপ্লিট সলিউশন টগি ফান ওয়ার্ল্ডে ভিড় জমাচ্ছেন। দেড় শতাধিক রাইড ও গেম রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই ভিআর থিম পার্কে। এখানে মানুষকে লেজার ট্যাগ, পেইন্ট বল, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ও অগমেন্টেড রিয়্যালিটি এবং আর্কেড গেম ও রাইডসের মতো রোমাঞ্চকর সব আয়োজন উপভোগ করতে দেখা যায়।
ঈদের ছুটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন রাজধানীর রমনা পার্ক, মানিক মিয়া এভিনিউ ও চন্দ্রিমা উদ্যানে নানা শ্রেণির মানুষকে দেখা যায়। অনেকে আবার গাড়ি নিয়ে ঘুরতে গেছেন পদ্মাপাড়ে। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে ছিল ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বেড়ানোর সুযোগ। পরিবার নিয়ে অনেককেই দেখা যায় ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের খোলা জায়গাটিও ছিল মানুষের পদচারণে মুখর। প্রচুর মানুষ এখানে আসেন ঈদের ছুটিতে। পাশাপাশি চন্দ্রিমা উদ্যানেও যান বহু মানুষ।
সৈকতে আনন্দে বিভোর পর্যটকরা : কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, টানা ছুটিতে কক্সবাজার গিয়ে বর্ষার উত্তাল সাগরে ঈদ আনন্দে মেতেছে ভ্রমণপিপাসুরা। আবহাওয়ার পরিবর্তনে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানো এক অন্যরকম সৈকত উপভোগ করেছেন তারা। এতে যেন কোনো ধরনের ব্যাঘাত না হয় এজন্য থাকছে বাড়তি নিরাপত্তা। সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে দেখা যায় বৃষ্টি ও মেঘলা আকাশ, বড় বড় ঢেউ। একেক সময় একেক রূপ ধারণ করছে আবহাওয়া। এ যেন মোহনীয় ভিন্ন এক সৈকত। সকালে বৃষ্টি হওয়ায় পর্যটক কিছুটা কম দেখা গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পর্যটকদের চাপ। পরিবার-পরিজন কিংবা প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে সৈকতে আনাগোনা মানুষের। সবচেয়ে বেশি আনন্দের ছাপ দেখা যায় শিশুদের চোখে-মুখে।সৈকতের বিশাল বালিয়াড়ি আর সামনে বিশাল সমুদ্র। এই দৃশ্য ধারণ করছেন সবাই। কেউ জেড স্কিতে চড়ছেন আবার কেউ কেউ খেলা করছেন বালি নিয়ে। ভ্রমণপিপাসুরা বলছেন, ঈদ আনন্দ দ্বিগুণ করতেই কক্সবাজার ছুটে আসা। ঢাকার মতিঝিল থেকে আসা পর্যটক হাবিবুর রহমান বলেন, ঈদ যেমন আনন্দের, ঠিক তেমনি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আসা আরও আনন্দের। দুই আনন্দ মিলে খুব উপভোগ করছি বর্ষাকালের সমুদ্রসৈকত। অন্যদিকে হাজারো পর্যটকের নিরাপত্তায় বাড়তি ব্যবস্থা নিয়েছে লাইফ গার্ড কর্মীরা। সি সেফ লাইফ গার্ডের সুপারভাইজার সাইফুল্লাহ সিফাত বলেন, ঈদে আনন্দ করার জন্য বিপুলসংখ্যক পর্যটক কক্সবাজার ছুটে আসবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু বর্ষাকাল, সাগর উত্তাল তাই পর্যটকদের সমুদ্রস্নানে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের সমন্বয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আগত পর্যটকরা স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারছেন। পর্যটকদের হয়রানি রোধে সব সময় মাঠে রয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। কেউ অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাঙামাটি পর্যটক কেন্দ্রে স্থানীয়দের ভিড় : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান রাঙামাটি পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে স্থানীয়দের ভিড়। তবে ছিল না দূর-দূরান্তের পর্যটক। এবার ঈদের ছুটিতে আশানুরূপ পর্যটক না পেয়ে হতাশ হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং আশপাশের জেলা মিলে এবার তৃতীয় দিনে মাত্র ২ হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সে। বেশির ভাগ হোটেল-মোটেল ছিল ফাঁকা। তবে স্থানীয় ভ্রমণপিপাসু ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের পদচারণে মুখরিত ছিল রাঙামাটির পর্যটন কেন্দ্রগুলো। স্থানীয় পর্যটক রায়হান হাসান বলেন, পর্যটন নগরী রাঙামাটিতে পর্যটকদের আনন্দ ও মনোরঞ্জন জোগানোর জন্য পর্যটন ঝুলন্ত সেতুসহ অসংখ্য নৈসর্গিক কেন্দ্র সরকারি পর্যটন মোটেল, ডিসি বাংলো পার্ক, সুবলং ঝরনা ও ভাসমান রেস্টুরেন্ট, রাঙামাটি পার্ক, সুখী নীল গঞ্জ, স্বচ্ছ কাপ্তাই হ্রদের জলে রোমাঞ্চকর নৌ-ভ্রমণ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও প্রাচীন নিদর্শন। কাপ্তাই আসামবস্তি সড়ক, ফুরামন পাহাড় খুবই সুন্দর। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া কোথাও ছিল না। উন্নয়ন হয়নি। পর্যটন কেন্দ্রগুলো ঢেলে সাজানো গেলে পর্যটকদের থাকার আগ্রহ বাড়বে। রাঙামাটি পর্যটন মোটেল ও হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা বলেন, ঈদে রাঙামাটিতে পর্যটন কমপ্লেক্সে দৈনিক ৪ থেকে ৫ হাজার পর্যটক আসে। তবে এবার তেমন পর্যটক আসেননি। অনেকে বুকিং করেও আসেননি।
চট্টগ্রামে বিনোদন কেন্দ্রে দর্শনার্থীর ভিড় : চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, ঈদুল আজহা এবং শুক্র-শনিবার মিলে এবার ঈদে বন্ধ ছিল টানা পাঁচ দিন। ফলে ঈদ সামনে রেখে বিনোদনপ্রেমীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল চট্টগ্রামের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় জমায়। গত মঙ্গল ও বুধবার চট্টগ্রামের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীর ভিড় দেখা যায়। চট্টগ্রামের বিনোদন কেন্দ্রগুলো- পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, ডিসি পার্ক, ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও ওয়াটার পার্ক সি ওয়ার্ল্ড, পতেঙ্গা প্রজাপতি পার্ক, কর্ণফুলী নদীর অভয়মিত্র ঘাট, বহদ্দারহাট স্বাধীনতা পার্ক, আগ্রাবাদ কর্ণফুলী শিশুপার্ক, হালিশহর সাগর পাড় ছাড়াও সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সাগর পাড়, মিরসরাইয়ে মহামায়া লেক, আনোয়ারায় পারকি সমুদ্রসৈকতে ভিড় জমে দর্শনার্থীর। তবে সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থীর সমাগম হয় পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে। প্রতিদিন পড়ন্ত বিকাল হতেই হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলায় মুখর হয়ে উঠে পুরো সৈকত এলাকা। কেউ মেতে ওঠেন সমুদ্রস্নানে, অনেকে চড়েন স্পিডবোটে, কেউ কেউ ঘোড়ার পিঠে। তাছাড়া জেলা প্রশাসনের পরিচালিত চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় প্রতিদিনই থাকছে দর্শনার্থীর ভিড়। চিড়িয়াখানায় সাদা বাঘ থেকে শুরু করে সিংহ, বানর, হনুমান ও বিভিন্ন প্রজাতির হরিণসহ পশুপাখি দেখতে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে এসেছেন বয়স্করাও। পাশাপাশি পাহাড়ের মাঝখানে থাকা রাইডগুলোতে চড়ে আনন্দ উপভোগ করছে শিশুরা। এ ছাড়াও আছে ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট ও ওয়াটার পার্ক।
কুয়াকাটায় বৃষ্টিবিলাসে মেতেছেন পর্যটক : কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, ঈদুল আজহার ছুটিতে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় ঢল নেমেছে পর্যটকদের। বুধবার সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো হালকা, কখনো মাঝারি বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে নেচেগেয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠছেন শিশুসহ নানা বয়সি আগত পর্যটক। কেউ মেতেছেন বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড়ে, কেউবা আবার সৈকতের বেঞ্চিতে বসে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। কেউ ঘোড়া, ওয়াটারবাইক কিংবা মোটরসাইকেল চড়ে ঘুরে দেখছেন দর্শনীয় স্থান। এ ছাড়া তিন নদীর মোহনা, লেম্বুর বন, ঝাউবাগান ও গঙ্গামতী সৈকতসহ সব স্পটে পর্যটকদের আনাগোনায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। একই সঙ্গে পর্যটকদের আগমনে আবাসিক হোটেল-মোটেল, খাবার ঘর ও শপিং মলসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বেড়েছে বেচাকেনা। এদিকে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ-পুলিশ, থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। পর্যটন সংশ্লিষ্টারা জানান, তীব্র দাবদাহ ও দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল জনজীবন। ঈদের তৃতীয় দিনে বুধবার সকাল থেকে হঠাৎ করে বৃষ্টিতে স্বস্তি ফিরেছে পর্যটন এলাকায়। জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে সৈকতের পূর্ব ও পশ্চিম দিকের কয়েক কিলোমিটারজুড়ে আগত পর্যটকরা মেতেছেন আনন্দ উল্লাস ও সমুদ্রস্নানে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা-টোয়াক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন রাজু বলেন, গতকাল এবং ঈদের দিন পর্যটক কম ছিল। কিন্তু ঈদের তৃতীয় দিনে বুধবার সকাল থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে বৃষ্টির কারণে আগত অনেক পর্যটক হোলেটের রুম থেকে বের হননি। আশা করছি শুক্রবার পর্যন্ত এমন অবস্থা থাকবে।
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় বিভিন্ন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া মাঠে নৌ-পুলিশ, থানা পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও রয়েছেন। আশা করছি পর্যটকরা নিরাপদে তাদের ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন।
দিনাজপুরের বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড়
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, ঈদের দিন থেকেই শহর ছেড়ে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ একটু দূরে পরিবার পরিজন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যায় মানুষ। তবে জাতীয় উদ্যান রামসাগর, বীরগঞ্জ শালবন ছাড়া বেসরকারি বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেই বেশি ভিড় ছিল। তবে আকাশ মেঘলা ও মাঝে বৃষ্টিপাতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে দর্শনার্থীদের। শহরের যান্ত্রিকতা আর জীবনের একগুঁয়েমি দূর করতে কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি সময় কাটাতে সব বয়সের মানুষ ছুটছে দিনাজপুরের পুনর্ভবা নদীতে নির্মিত গৌরীপুর সেতুসহ স্লুইচগেট এলাকায়। এ ছাড়াও বিনোদনপ্রেমী মানুষের একটু বিনোদনের চাহিদা মেটাতে সবার দৃষ্টি কেড়েছে দিনাজপুরের বড়মাঠ এলাকা, শিশুপার্ক, সিটি পার্ক, দাদুবাড়ী, মোহনপুরের রাবার ড্যাম, বিরলের জীবনমহল, নবাবগঞ্জের মায়াবী স্বপ্নময় ভুবন স্বপ্নপুরী, শেখ রাসেল জাতীয় উদ্যান এবং বনের মাঝে আশুড়ার বিলের ওপর আঁকাবাঁকা দৃষ্টিনন্দন শেখ ফজিলাতুন নেছা কাঠের সেতু, বীরগঞ্জের সিংড়া ফরেস্টসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র।