বুধবার, ১০ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
জনশক্তি রপ্তানি

শেষ ভরসা সৌদি আরব

♦ ১০ মাসে বিদেশ গেছে ১০ লাখ শ্রমিক ♦ শুধু সৌদিতে গেছে ৪ লাখ ৬১ হাজার ♦ শ্রমিকদের বেশির ভাগই অল্প ও আধাদক্ষ ♦ পেশাজীবী ও দক্ষ শ্রমিকের হার কমে যাচ্ছে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেটের কারণে বিদেশে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের শেষ ভরসা এখন সৌদি আরব। মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোতে কাজের বিপুল সুযোগ থাকলেও সিন্ডিকেটের কারণে সেই সুযোগ বন্ধ হতে চলেছে। গত এক দশকের জনশক্তি রপ্তানির তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৪-এ বলা হয়েছে, চলতি দশকে দেশভিত্তিক জনশক্তি রপ্তানির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এক দশক আগে ২০১৪ সালে কাতার, ওমান, সিঙ্গাপুরে ৫৮ শতাংশের বেশি শ্রম রপ্তানি হলেও চলতি বছরে ওই দেশগুলোতে শ্রম রপ্তানি কমে গেছে। এর বদলে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবই হয়ে উঠেছে শেষ ভরসা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক দশক আগেও মধ্যপ্রাচ্যের ওমান, কাতার, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত এমন কি লিবিয়া ও সিরিয়াতে যে হারে শ্রম রপ্তানি হয়েছে নানা সংকটে এখন সে দেশগুলোতে শ্রম রপ্তানি কমে গেছে। অনেক দেশে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে সৌদি আরবের ওপর ভর করে বাংলাদেশের শ্রম রপ্তানির চাকা ঘুরছে। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে ওই অঞ্চলে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে কারণে শুধু একটি অঞ্চল বা একটি দেশের ওপর জনশক্তি রপ্তানির নির্ভরতা বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

জনশক্তি ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং অর্থনৈতিক সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সদ্য সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছেন কাজের উদ্দেশে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ৪ লাখ ৬১ হাজার ৪১১ জন, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির প্রায় ৪৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ৮০ হাজার, কাতারে প্রায় ৬৬ হাজার ৬০০, ওমানে প্রায় ৫২ হাজার এবং কুয়েতে প্রায় ২৯ হাজার জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শ্রম রপ্তানি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে মালয়েশিয়ায়। গত অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ২ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক গেছেন কাজের উদ্দেশ্যে। তবে সিন্ডিকেট চক্রের অনিয়ম দুর্নীতি এবং অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের কারণে ৩১ মের পর  থেকে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ। ফলে সামনের দিনগুলোতে জনশক্তি রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে পেশাজীবী ও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির হারও কমে গেছে। এর বদলে শ্রম রপ্তানিতে অল্প ও আধা দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে বেশি সংখ্যায় শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে গেলেও রেমিট্যান্স আসছে কম। অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, ২০১২ সালে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল অল্পদক্ষ। সেখানে ২০২৩ সালে যাওয়া শ্রমিকদের প্রায় ৫০ শতাংশ ছিলেন অল্প দক্ষ। এ ছাড়া ২০১২ সালে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ দক্ষ এবং প্রায় ৬ শতাংশ পেশাজীবী জনশক্তি রপ্তানি হলেও ২০২৩ সালে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির হার ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পেশাজীবী শ্রমিকের হার ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষ ও পেশাজীবী শ্রমিকের তুলনায় অল্প দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রম রপ্তানি বেড়ে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়ার পরও রেমিট্যান্স আয় কম আসছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)’র সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কামাল মুজেরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি হুমকির মুখে আছে। দুর্নীতি, অনিয়ম আর সিন্ডিকেটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে সবচেয়ে বড় বাজার মালয়েশিয়ায় শ্রম রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র ভরসা মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট আরও ঘনীভূত হলে সৌদি আরবেও শ্রম রপ্তানি আটকে যেতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বেশির ভাগ শ্রমিক অদক্ষ ও অল্পদক্ষ। এটি জনশক্তি রপ্তানির আরেকটি ঝুঁকি। এ কারণে সরকারের উচিত হবে জনশক্তি রপ্তানিতে একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ করা, যে নীতির মাধ্যমে সম্ভাবনাময় বাজার খুঁজে বের করার পাশাপাশি ওই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া। এর ফলে শুধু জনশক্তি রপ্তানিতে ঝুঁকি কমবে তাই নয়, দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর ফলে অল্প জনশক্তি রপ্তানি করেও বেশি রেমিট্যান্স আয় করা যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর