বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ও আমার বাংলাদেশ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ও আমার বাংলাদেশ

আজ থেকে ঠিক ৪৪ বছর আগে অগ্রহায়ণ মাসে (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) পৃথিবীর মানচিত্রে যে নতুন দেশটি যুক্ত হয়েছিল তার নাম বাংলাদেশ। তার আগে ন’মাসের যুদ্ধ প্রস্তুতির সময় একটি গান লেখা হয়েছিল— ‘ও আমার বাংলাদেশ’। গোটা দেশে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। এপার বাংলায় বসেও কোটি কোটি মানুষ সে গান গেয়েছিলেন। যে গান উজ্জীবিত করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে। কার্যত যুদ্ধ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। ১৩ দিনের যুদ্ধ শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর। সমর সংবাদদাতা হিসেবে আমার যুদ্ধ শুরু হয় সে বছর ৭ মার্চ। যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার ঐতিহাসিক রমনা ময়দান থেকে ঘোষণা করেছিলেন— ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।... জয় বাংলা।’ আমি দেখেছি রাজাকার, আলশামস, আলবদরের লোকরা দিনের পর দিন বাঙালিকে হত্যা করেছে। আমি দেখেছি পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন। ১৯৭৩-এর নির্বাচন। শেখ মুজিবের কলকাতা সফর, ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফর সবই আমি রিপোর্ট করেছি। পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি ন্যাপের চীনপন্থি নেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কীভাবে সিপিএমকে দলে টানলেন সে কথা বলা যাক।

তখন মে মাস। অর্থাৎ কবির ভাষায় দারুণ চৈত্র মাস। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য প্রয়াত হরেকৃষ্ণ বোঙার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কড়া সমালোচনা করে বললেন, ‘ইন্দিরা শুধু পাকিস্তানকেই ভাঙছেন না। উপমহাদেশে এক অশান্তির সৃষ্টি করতে চাইছেন। বিস্মিত বাঙালি। মুক্তিযোদ্ধারা। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে সরকার। ওপার বাংলা থেকে আসা লাখো মানুষ সেদিন সিপিএমকে ধিক্কার জানিয়েছিল। সে সময় কলকাতার রাস্তায় সিপিএমবিরোধী মিছিলে মিছিলে সয়লাব। আনন্দবাজারে একদিন একটা টেলিফোন এলো। বক্তা জানতে চাইলেন কলকাতায় সিপিএমের অফিসটা কোথায়? আরেকটা টেলিফোন এলো ভারত সরকারের বিএসএফ সদর দফতর থেকে। তাড়াতাড়ি একজন ফটোগ্রাফার নিয়ে তাদের অফিসে যাওয়ার অনুরোধ এলো। সেখানে যাওয়া মাত্রই প্রাক্তন জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রয়াত শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় বললেন, গাড়িতে উঠুন। চলুন পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর বিল্ডিংয়ে। সেখানে ছিলেন ভাসানী। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করে আপনারা ঠিক কাজ করছেন। আমরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করছি। আর ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির বক্তব্য আমরা বর্জন করছি। অপরদিকে বেজিং থেকে একটি বক্তব্য এলো হরেকৃষ্ণ বোঙারের বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে। ভারত সরকার থেকে বেজিংয়ের মন্তব্যের বিরোধিতা করা হয়েছিল। ব্যাপারটা সেখানেই তখনকার মতো শেষ হয়ে গেছিল।

তখন পুরোদমে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কলকাতার সাংবাদিকদের পাশাপাশি শহরে তখন বিদেশি রিপোর্টারদের ভিড়ও বাড়ছে। কলকাতার বেশ কয়েকটা বড় হোটেলে সব ঘর বুক করে ফেলেছিলেন ওই রিপোর্টাররা। কলকাতার রিপোর্টাররা জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়েছেন। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি। কখনো সঙ্গী বিএসএফ জওয়ান। সে সময় তৈরি হলো মুজিব বাহিনী। বাহিনীর পর বাহিনী।

পশ্চিমবঙ্গে তখন রাষ্ট্রপতি শাসন। এমন কোনো জেলা নেই যেখানে শরণার্থী শিবির নেই বা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের শিবির নেই। বিদেশ থেকে দলে দলে রাষ্ট্রনায়করা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছেন। জাপান, জার্মানি, ব্রিটেন, কানাডা— সব দেশের রাষ্ট্রনায়করাই পাকিস্তানের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখে গেছেন। দেশে ফিরে গিয়ে তারা ইয়াহিয়া খান আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর সামরিক বাহিনীর তাণ্ডব দেখেছেন। আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা রেডিও থেকে এই অত্যাচারের কাহিনী প্রচার করা হতো। কলকাতার কাগজগুলোর মধ্যে তখন যুদ্ধ কভার করা নিয়ে চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা, কখনো কখনো আমরা বিদেশি সাংবাদিকদের দোভাষীর কাজও করেছি। যেসব রিপোর্ট আমি করেছি তার পুরোটাই আনন্দবাজারের লাইব্রেরিতে রয়েছে। তারই কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করব মাত্র। সে সময় দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলে রিপোর্ট করার সময় খবর পেয়েছিলাম শিগগিরই স্বাধীন হতে চলেছে বাংলাদেশ। সরকারের রাজধানী আপাতত হবে বগুড়ায়। আওয়ামী লীগের নেতা মনসুর আলী হবেন এই সরকারের প্রধান। নতুন সরকার গঠিত হবে ২০ জন মন্ত্রীকে নিয়ে। এ ঘটনা অবশ্য ঘটেনি। স্মৃতি খুঁড়ে বের হচ্ছে— দিনাজপুরের চারদিকে তখন বারুদের গন্ধ, খোঁজা হচ্ছে মুজিবুর রহমানকে। বিদেশি সাংবাদিকদের তাজউদ্দীন বলছেন— মুজিব কোথায় বলব না, শরণার্থী শিবিরগুলোয় আশ্রয় নেওয়া মানুষদের অমানুষিক দুঃখের কাহিনী, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের মনোভাব এবং তার রকমারি ব্যাখ্যা, পশ্চিমবঙ্গ সফরে এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, এরই মধ্যে নতুন দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন, ফারাক্কা বাঁধ উড়িয়ে দেওয়ার ইয়াহিয়া খানের চক্রান্ত এবং ভারতীয় সেনারা কীভাবে তা ব্যর্থ করলেন তার আখ্যান, বাংলাদেশে জজিয়তির নিশ্চিন্ত পেশা ছেড়ে যুদ্ধে নেমে পড়লেন প্রথিতযশা বিচারপতিরা, চীনের চিঠি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তীব্র ভর্ত্সনা, মুক্ত হলো গুরুত্বপূর্ণ রেলবহর পার্বতীপুর, পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে হিলিতে চলছে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ, পেট্রাপোল সীমান্তে যশোর দুর্গ দখলের রোমহর্ষ কাহিনী, অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে কীভাবে উদ্ধার করে আনা হলো ৪১৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে, বেগম মুজিবের সঙ্গে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশর সাক্ষাৎ। একের পর এক মুক্ত হচ্ছে চালনা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিকরগাছা, দর্শনা, বয়রা ইত্যাদি।

কখনো ট্রাকে, কখনো সামরিক বাহিনীর ট্যাঙ্কে, কখনো হেলিকপ্টারে, কখনো আবার ফোর্ট উইলিয়ামের সদর দফতর থেকে। ৭ মার্চ আমি অল ইন্ডিয়া রেডিওর দফতর থেকে মুজিবের বক্তৃতার কপি নিয়ে এসেছিলাম। তারপর লাগাতার রিপোর্ট করে গেছি মুক্তিযুদ্ধের। কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ ছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। সে কথায় পরে আসছি।

১৩ দিনের এই যুদ্ধ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর রাত ৮টায়। সেদিন সকাল থেকে ভারতের ওপর হামলা শুরু করেছিল পাকিস্তান। সে সময় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কলকাতায়। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভা ছিল। দুপুরে তার বক্তব্য শুনতে প্রচুর মানুষ এসেছিলেন। তার বক্তৃতার মাঝখানে আমাদের এক দাদা বললেন, চলো উনি যাওয়ার আগেই রাজভবনে যাই। রাজভবনের গেটে হাতে একগুচ্ছ টেলেক্স নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তত্কালীন মুখ্য সচিব নির্মল সেনগুপ্ত। ইন্দিরাকে টেলেক্সগুলো পড়ে শোনালেন নির্মলবাবু। তাকে বলা হলো উত্তর ভারতের ২৭টি জায়গায় পাক বিমান বাহিনী হামলা করেছে। বহু মানুষ আহত হয়েছেন। ভারত আক্রান্ত। ভারত কী জবাব দেবে? বললেন, আমাকে দিল্লি পৌঁছতে হবে। মন্ত্রিসভার বৈঠক করতে হবে। দিল্লি ফিরে গিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক করে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তিনি বললেন, পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে। আমরা এর সমুচিত জবাব দেব। সেই সঙ্গে গোটা দেশে ব্ল্যাকআউট করে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হলো। সারা রাত ধরে চলল সেই যুদ্ধ।

তিন দিন পর থেকে একটার পর একটা জায়গা দখল করছে ভারতীয় বাহিনী। সে সময় কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসেছিলেন তত্কালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম। তাকে প্রশ্ন করা হয়, পাকিস্তানকে সাহায্য করতে তো আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠাচ্ছে। এবার কী হবে? স্বভাবরসিক বাবুজি বলেছিলেন, আমরা তো আটটা নৌবহরকে ভারত মহাসাগরে ডুবিয়ে দিয়েছি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, কি ঠিক বলেছিলাম কিনা? সে সময় আমেরিকায় তত্কালীন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছিলেন, আমেরিকার বিদেশনীতি একটা পরিবারের হাতে শেষ হয়ে গেল। আমরা ওই পরিবারটিকে ছাড়ব না। ঠিক তাই হয়েছিল। ইন্দিরা, সঞ্জয় আর রাজীব গান্ধীকে হত্যা করেছিল তারা। ৭-৮ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে জেনারেল মানেকশ ভারতের সমস্ত ভাষায় পাকিস্তান বাহিনীর উদ্দেশে বার্তা দিতে থাকেন, তোমরা কে কোথায় আছ তা আমরা জানি। ভারতীয় জওয়ানদের কাছে আত্মসমর্পণ কর। এরপরেই একটা নড়াচড়া পাক বাহিনীর মধ্যে। তলার স্তরের জওয়ানরা উপরতলার অফিসারদের চাপ দিতে থাকেন। এরপর পাক সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা করেন পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল এ কে নিয়াজি। সে সময় তারা আত্মসমর্পণে রাজি হয়ে যান। ৯৩ হাজার সেনা নিয়ে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান বাহিনী। সিমলা চুক্তি পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সেনা সরাতে থাকলেন।

এবার বলি কেন আমি সে সময় উপস্থিত থাকতে পারিনি। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে আমাদের জানানো হয়েছিল সকাল ৭টার মধ্যে আনন্দবাজারের আমি আর যুগান্তরের চিফ রিপোর্টার অনিল ভট্টাচার্য যেন ফোর্ট উইলিয়ামে চলে যাই। হেলিকপ্টারে করে আমাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের বসিয়ে রাখা হলো সারা দিন। সারা দিন ধরে বিদেশি রিপোর্টারদের দফায় দফায় ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা বারবার বলা সত্ত্বেও আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়নি। বিকাল ৫টার সময় আমাদের বলা হলো সন্ধ্যে হয়ে গেছে এখন আর হেলিকপ্টার উড়বে না। হেঁটে হেঁটে অফিস পৌঁছলাম। সম্পাদক অশোক সরকার জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখলেন? আমি পুরো ঘটনাটা তাকে বললাম। সম্পাদক অশোকবাবু আর জগজীবন রাম স্বাধীনতা আন্দোলনে একসঙ্গে জেল খেটেছিলেন। তিনি সোজা ফোন করলেন জগজীবন রামকে। দু’দিন পরে আমার যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই সময় থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান হত্যা ষড়যন্ত্র পর্যন্ত বাংলাদেশেই ছিলাম।

এটাকেই বলে দুর্ভাগ্য। গোটা যুদ্ধ কভার করেও আত্মসমর্পণের দিন আমি যেতেই পারলাম না। তবে যুদ্ধ ফ্রন্টে থেকে কভার করার সুযোগ চেয়েছিলাম। সেটাই আমার কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার।

 

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর