বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফায়ারম্যান সোহেলের দাফন সম্পন্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডে আটকে পড়াদের বাঁচাতে গিয়ে নিহত ফায়ারম্যান সোহেল রানার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে কিশোরগঞ্জের ইটনা থানার চৌগাঙ্গা পুরাতন বাজার জামে মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। এর আগে বেলা ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরে সোহেল রানার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানাজা শেষে সোহেল রানার পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সোহেল পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসসহ আমরা সবাই তার পরিবারের প্রতি লক্ষ রাখব।

 তার পরিবারে যদি উপযুক্ত কেউ থাকে তাকে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সোহেল রানা জনগণকে ভালোবাসতেন, দেশকে ভালোবাসতেন, এরই প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন।’

সাহসী সোহেলের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এফআর টাওয়ারে উদ্ধার করতে গিয়ে তিনি নিহত হয়েছেন। তার মৃত্যুর জন্য আমরা গভীরভাবে দুঃখিত।’ তিনি বলেন, ‘শুধু সোহেল নয়, আমি স্মরণ করতে চাই সিলেটের জঙ্গি হামলার সময় নিহত ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তাকে। আমাদের যেখানে প্রয়োজন অগ্নিসেনারা সেখানে গিয়ে কাজ করছেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে জানমাল রক্ষা করছেন।’

সোহেল রানার চিকিৎসার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রথমে তাকে সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়েছে। আমরা সোহেল রানার পরিবারকে সহযোগিতা করব। ইতিমধ্যে ফায়ার সার্ভিস তাকে সহযোগিতা করেছে। প্রধানমন্ত্রীও সহযোগিতা করবেন।’

এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চারদিকে অন্ধকার দেখছেন সোহেল রানার পরিবারের সদস্যরা। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেছেন নিহত সোহেলের ছোট ভাই উজ্জ্বল মিয়া।

সোহেল রানার প্রথম জানাজায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ফায়ার সার্ভিসের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ খান, পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী অংশ নেন।

এ ছাড়া দ্বিতীয় জানাজায় কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক সারওয়ার মোর্শেদ চৌধুরী, পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদসহ ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, পরিবার, আত্মীয়স্বজনসহ কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।

ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরে গিয়ে দেখা গেছে, সকালেই অ্যাম্বুলেন্সে করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমইএচ) মর্চুয়ারি থেকে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরে সোহেলের লাশ আনা হয়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে বাহিনীর কমলা রঙের পতাকায় মোড়া সোহেল রানার কফিন নামানোর পরই তার সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মুহূর্তের মধ্যে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

কফিনের পাশে অশ্রুসিক্ত নয়নে দাঁড়িয়ে ছিলেন সোহেলের শেষ কর্মস্থল কুর্মিটোলা ফায়ারস্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার বজলুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘ছেলেটার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছি না। আমার সঙ্গে সে কাজ করত। ঘটনার দিন আমার সঙ্গেই এফআর টাওয়ারে গিয়েছিল।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি সোহেলের বাবা, মা ও ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।’ ফায়ারম্যান হাসান বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছি। কখনো ভাবতে পারিনি সোহেল এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। সোহেল খুব ভালো ছিল। কম কথা বলত। কিন্তু সবার সঙ্গে মিশত।’

জানাজার আনুষ্ঠানিকতায় স্বজনদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন রানার ছোট ভাই উজ্জ্বল মিয়া। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে আমরা পথে বসে গেছি। আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রী যাতে আমাদের পরিবারের প্রতি সুদৃষ্টি দেন।’

তিনি বলেন, ‘আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্য কাজ করতেন, পরোপকারী ছিলেন। তিনি দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন আমরা এতে গর্বিত। আমরা চাই সবাই যেন তার মতো দেশের জন্য কাজ করতে পারি। আমার ভাইয়ের যদি কোনো ভুলত্রুটি থাকে তাহলে আপনারা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। দোয়া করবেন, তিনি যেন জান্নাতবাসী হন।’

২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর আটকে পড়াদের উদ্ধারে অংশ নিয়েছিলেন ফায়ারম্যান সোহেল রানা। উদ্ধারের একপর্যায়ে ওভারলোড দেখায় লেডারটি। পরে ওজন কমাতে মই বেয়ে নামতে গিয়ে লেডারের ভিতর পা চলে যায় সোহেল রানার। পেটও থেঁতলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। রবিবার বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত সোয়া ২টায় তিনি মারা যান। সোমবার রাতে তার লাশ দেশে আনা হয়।

সর্বশেষ খবর