বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

একজন বিচারকের ভাবনায় ’৭১-এর শরণার্থী জীবন

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

একজন বিচারকের ভাবনায় ’৭১-এর শরণার্থী জীবন

“দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়”... ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। পেয়েছি আমাদের অভীষ্ট স্বাধীনতা। এরকম চরম মূল্যের বিনিময়ে পৃথিবীর আর কোনো দেশ স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জন করেছে কি না তা আমার জানা নেই। এই চরম আত্মত্যাগের পাশাপাশি আরও একটি ত্যাগ এ দেশের অন্তত কোটি মানুষকে করতে হয়েছিল; বাস্তুচ্যুত হয়ে তাদের বরণ করতে হয়েছিল শরণার্থী জীবন।

১৯৭১ সাল। কোটি মানুষের মতো আমরাও নিজেদের বাড়িঘর ও আত্মীয়-স্বজনকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলাম। বাস্তুচ্যুত হয়ে সপরিবারে হয়েছিলাম দেশান্তরি। আশ্রয় পেয়েছিলাম ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ উদযাপন করেছে স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি। অনেক সংগঠন ও অনেক প্রতিষ্ঠানেরও ৫০ বছরপূর্তি হয়েছে ২০২১ ও ২০২২ সালে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিভাগের তিন বাহিনীর অবদান অপরিসীম। তারাও ২০২২ সালে তাদের সংগঠনের বা বাহিনী গঠনের ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন করেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিচারকগণসহ সারা দেশের মানুষ পালন করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী। আমরা ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছিলাম বলেই এই দিনগুলোকে আমরা উদযাপন করতে পেরেছি। আর যাঁর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছে, মা-বোনেরা হারিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ সম্মান ও সম্ভ্রম তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে ২০২০-২০২১ সালে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা যে মহামানবের হাত ধরে হয়েছে সেই মহামানবের জন্মশতবার্ষিকী আমাদের পালন করতে হয়েছিল কিছু সীমিত আকারে, করোনা মহামারির কারণে। তবে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে এই রাষ্ট্র, এই জাতি, আমরা সবাই তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছি।

১৯৪৭ সালের পর থেকেই এই ভূখণ্ডের বাঙালিরা পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিল। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন- ‘২৩ বছরের ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস’। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা শহরের সর্বত্র আক্রমণ চালায় বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তারপর পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। বন্দি করে রাখে পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে। আর এদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের মানুষ যার যা ছিল তাই নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বর্বর পাকিস্তানিদের আক্রমণের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত কোটি মানুষ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তিতে আমি একটি লেখায় একাত্তরের শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম যার শিরোনাম ছিল, ‘একাত্তরের শরণার্থী জীবন : ৫০ বছরপূর্তি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা’।

জুলাই মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে কোনো একদিন হঠাৎ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ আব্বা আমাদের আশ্রয়স্থল কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার জাউয়ার গ্রামের পীর বাড়িতে (আমার ফুপুর বাড়ি, যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম) এসে উপস্থিত হন। বাবা আমাদের যত শিগগির সম্ভব মেঘালয়ের মহেশখোলায় চলে যেতে বলেন। দুপুরের ঠিক কিছু আগে এসে তিনি কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে রাতের আঁধারে আবার নৌকাযোগে বিস্তীর্ণ হাওর পাড়ি দিয়ে গারো পাহাড় বেষ্টিত মহেশখোলায় ফিরে যান

আজ আমি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ মিলিয়ে প্রায় ১০০ জন বিচারক কর্মরত আছেন। আমার জানা মতে, বিচারকদের মধ্যে অন্তত তিন-চারজন বিচারক আছেন ও ছিলেন যাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে আমি ছিলাম ১২ বছরের কিশোর। আপিল বিভাগের বিচারপতি জনাব এম. ইনায়েতুর রহিম আমার চেয়ে বয়সে দেড় বছরের ছোট এবং হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি জনাব কামরুল কাদেরের বয়স সম্ভবত ১৯৭১ সালে ১০ বছরেরও কম ছিল। আমরা তিনজন মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে শরণার্থী হিসেবে ছিলাম। সম্প্রতি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচারকের বিদায় সংবর্ধনায় আমি যখন এ তথ্যটি উপস্থাপন করি তখন যেহেতু আর কোনো বিচারক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের শরণার্থী জীবনযাপন করেছেন এমন দাবি করেননি, এতে ধরে নেওয়া যায়, বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ মিলে ১৯৭১-এর শরণার্থী বিচারকের সংখ্যা তিনজন। আমি এবং কামরুল কাদের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত মহেশখোলা কেন্দ্রে শরণার্থী হিসেবে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি। কামরুল কাদেরের সঙ্গে তখন আমার পরিচয় ছিল না। তাঁর বাবাও মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও তাঁর পরিবার ছিল পশ্চিম বাংলার বালুবাড়ীতে (পশ্চিম দিনাজপুর)। তাঁর পিতা জনাব এম. আবদুর রহিম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন।

কেন আমরা ভারতে শরণার্থী নিয়েছিলাম? সেই প্রায় ১ কোটি মানুষ শরণার্থী জীবন কেন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল এর উত্তর জানা আছে সবারই। ঢাকায় বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে যে বর্বর হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল এবং এর মধ্য দিয়ে সারা দেশে মোতায়েনকৃত বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরপরাধ মানুষকে হত্যার নির্মম নির্দেশনা পেয়েছিল। আর নির্বিচারে হত্যা করেছিল নিরীহ বাঙালিদের। মানুষ দিশাহারা ও আতঙ্কিত হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে শহরের নিবাস ছেড়ে পরিবার নিয়ে ছুটেছে গ্রাম থেকে গ্রামে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। কিছুদিনের মধ্যে যখন পাকিস্তানি সেনারা তাদের এ দেশীয় কুখ্যাত দোসরদের সহায়তায় ও দোষাবহ প্ররোচনায় আমাদের গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়, এরপর থেকে নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠী ও হিন্দুু সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের আক্রমণ ও অত্যাচারের মাত্রা আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। সারা দেশের মানুষ বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও পরিবার-পরিজন পায়ে হেঁটে, গরুরগাড়িতে চড়ে বা নৌকায় চড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রাণরক্ষার জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। তখন ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস এবং দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মহীয়সী নারী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি এবং তাঁর সরকার যদি তাদের দেশের সীমান্ত অবারিত না রাখত, তাহলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কী মাত্রার মানবিক বিপর্যয় নেমে আসত সেটি ভাবা যায় না। আমি আমার আগের লেখায় লিখেছিলাম, ‘১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশন’ একটি অন্যতম আইনগত দলিল- যা সংজ্ঞায়িত করেছে, শরণার্থী কে এবং তার অধিকার কী ও তা কীভাবে নিশ্চিত হবে। এই কনভেনশন অনুযায়ী কেউ যখন ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তার কারণে বা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় চরম নিগ্রহ ও সহিংসতার শিকার হন এবং এ কারণে সৃষ্ট ভীতি তাকে তার দেশ বা ভূখণ্ডে অবস্থান করাটা অনিরাপদ করে তোলে তখন বাস্তুচ্যুত এই ব্যক্তি ‘শরণার্থী’। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি জনগণ হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, আটক-নির্যাতনের শিকারে পরিণত হওয়া এসব ছিল বেআইনি, মানবতাবিরোধী ও আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধও বটে।

সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আমার বাবা সাবেক গণপরিষদ সদস্য ডা. আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদ আওয়ামী লীগের মনোনীত সদস্য হিসেবে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ ও বারহাট্টা এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭১-এর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মুুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের লক্ষ্যে মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলার মহেশখোলা নামক স্থানে আশ্রয় নেন। এই মহেশখোলা ছিল নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের ভাটি এলাকার শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল। বাবা তখন এই তিন জেলার ভাটি অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নিজেকে নিবিষ্ট করেন। আমার মাসহ আমরা পরিবারের সব সদস্য দেশের ভিতরে বাস্তুচ্যুত হয়ে এ গ্রাম ও গ্রামে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকি।

মনে পড়ে জুলাই মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে কোনো একদিন হঠাৎ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ আব্বা আমাদের আশ্রয়স্থল কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার জাউয়ার গ্রামের পীর বাড়িতে (আমার ফুপুর বাড়ি, যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম) এসে উপস্থিত হন। বাবা আমাদের যত শিগগির সম্ভব মেঘালয়ের মহেশখোলায় চলে যেতে বলেন। দুপুরের ঠিক কিছু আগে এসে তিনি কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে রাতের আঁধারে আবার নৌকাযোগে বিস্তীর্ণ হাওর পাড়ি দিয়ে গারো পাহাড়বেষ্টিত মহেশখোলায় ফিরে যান। আমরা যখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে যে কোনো সময় ধরা পড়ার আশঙ্কা ছিল। এরকম এক পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে আমরাও ভারতের শরণার্থী জীবনটি বেছে নিতে রাজি হয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে, বাবা সাত/আট ঘণ্টা আমাদের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। তখন পাহাড় জঙ্গলে সাপ, বন্যপ্রাণী ও চিনে জোঁকের উপদ্রবের পাশাপাশি পানীয়জলের অসুবিধার কথা বলেছিলেন আমার আম্মাকে। এরকম অদেখা প্রতিকূল অবস্থা জানার পরও শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য এবং বাবা যাতে নির্বিঘ্নে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় মনোনিবেশ করতে পারেন সেই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট আমার মা-সহ আমরা চার ভাই-বোন উত্তাল হাওরের ঢেউ উপেক্ষা করে পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা মহেশখোলায় পৌঁছতে সক্ষম হই। বলা যায়, এই ১৪ আগস্ট ১৯৭১ ছিল আমাদের জীবনের প্রথম বিদেশ সফর। বিনা পাসপোর্টে, বিনা ভিসায় আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভিনদেশে প্রবেশ করি শরণার্থী হিসেবে। সে দিন যদি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ আমাদের ভারতে প্রবেশ করতে না দিত আর যদি দেশ স্বাধীন না হতো আর আমরা যদি জীবনে বেঁচে থাকতাম তাহলে আমরা হতাম পাকিস্তানের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক আর বাবা থাকতেন ভারতে রিফিউজি হিসেবে। জীবনে আর কোনো দিন বাবার সঙ্গে দেখা হতো কি না তা ছিল অনিশ্চিত।

শরণার্থী জীবনের দুঃখ-দুর্দশা কী তা একজন শরণার্থী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেভাবে জীবনযাপন করছে ১৯৭১ সালে বাঙালি শরণার্থীরা এরকম সুযোগ-সুবিধা কল্পনাও করতে পারেনি। কারণ তখন ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তার পরও ভারত সরকার ছিল মানবিক। তাদের পাশে ছিল বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো। বিভিন্ন শিবিরে দুর্বিষহ জীবন পার করেছে শরণার্থীরা। আমার মনে পড়ে, শুধু আমরা যে ক্যাম্পে ছিলাম সেখানে অপুষ্টিজনিত কারণে ও কলেরায় আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার শরণার্থী মৃত্যুবরণ করেছিল। বাবা যেহেতু পেশায় ছিলেন চিকিৎসক, তিনি ক্যাম্পের ইনচার্জ হওয়া সত্ত্বেও মেডিকেল টিমেরও প্রধান ছিলেন। তাঁকে দেখেছি সারা দিন না খেয়ে বিনা বিশ্রামে অন্য কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স সঙ্গে নিয়ে শরণার্থীদের চিকিৎসা করতে। তবুও সেই দিনগুলোতে বাঁচাতে পারেননি হাজার হাজার শরণার্থীর জীবন। দেখেছি হিন্দু ধর্মাবলম্বী শরণার্থীগণ নিকটজনের মরদেহের সৎকার সঠিকভাবে করতে পারেননি জ্বালানি কাঠের অভাবে।

শরণার্থী জীবনের অবর্ণনীয় কষ্ট চিত্রিত হয়েছে কবি জাফর ওয়াজেদের একটি লেখায়। লেখিকা পপি দেবী থাপার লেখা বই “শরণার্থীর জবানবন্দি ১৯৭১”-এর মুখবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “কল্যাণী ক্যাম্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা অশোক ভট্টাচার্য দেখেছেন সে সকরুণ জীবনযাপন। তাঁর অভিজ্ঞতা- ‘শরণার্থী শিবিরে মানুষজনের ভিড় অতিরিক্ত। তাদের জন্য বরাদ্দ সামগ্রীর কিছু সরকারি লোক আত্মসাৎ করে, কিছু নষ্ট হয়, ফলে ক্যাম্পে গিয়ে যা পৌঁছায়, তা অপর্যাপ্ত। ক্যাম্পে শিশুদের জন্য দুধের ব্যবস্থা আছে, তাদের কোলে নিয়ে বা হাতে ধরে মায়েদের লাইনে দাঁড়াতে হয়। লাইনে দাঁড়ানোর জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যায়। কেননা, সব সময় সবাইকে দেওয়ার মতো দুধ থাকত না। এ রকম অবস্থায় যিনি দুধ দিচ্ছিলেন, তিনি জানিয়ে দিলেন, দুধ কম আছে, সবাইকে দেওয়া যাবে না। যাদের না দিলেই নয়, শুধু তাদের দেওয়া হবে। সামনে শিশু কোলে নিয়ে এক মা দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক যেই দুধ দিতে যাবেন, পেছন থেকে কেউ তখন বলল, ওকে দেবেন না- ও বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারে। ভদ্রলোক মগে দুধ উঠিয়েও ইতস্তত করছেন, দেবেন কি দেবেন না। ভদ্রলোকের মুখের দিকে এক মুহূর্ত তাকাল সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি। তারপর কাপড় সরিয়ে ব্লাউজের বোতাম খুলে নিজের বুক অনাবৃত করে দিল। সন্তানকে স্তন্যদানের ক্ষমতা তার আছে কি না, দাতা তা নিজেই বিচার করুন।’

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির এই সুরম্য অট্টালিকা সমৃদ্ধ সুসজ্জিত বাসভবনে অবস্থান করে আজ কেন জানি হৃদয়ে জেগে উঠছে সেই ১৯৭১-এর শরণার্থী জীবনের কথা। এই বাসভবনে ইতঃপূর্বে সম্ভবত কোনো শরণার্থী বা যুদ্ধের ময়দানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা বসবাস করেননি। একজন শরণার্থীর জীবনে এই বাসভবনে অবস্থান ও বসবাস নিঃসন্দেহে অনেক অনেক বেশি প্রাপ্তি ও আনন্দের।

যে স্থানে ১৯৭১ সালে আমরা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলাম সেই জায়গাটি দেখার জন্য আমি ২০১৬ সালের ১৬ এপ্রিল পুনরায় সেখানে গিয়েছিলাম। সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানাধীন নাকুগাঁও সীমান্ত দিয়ে দুপুর ১টায় আমি ও আমার ছোটভাই সাইফুল হাসান (সোহেল) ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করি। ১৯৭১ সালে আমার এই ভাইটির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। পশ্চিম গারো হিলস ও দক্ষিণ গারো হিলসের জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ও বিএসএফের কর্মকর্তাগণ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাকে অবহিত করেছিলেন, আমি তাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি। আমার প্রতি এ ধরনের সম্মানসূচক আচরণ সেদিন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালের অনেক স্মৃতিতে। যখন আমি এই মেঘালয় রাজ্যে সপরিবারে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছিল মেঘালয় সরকার, আমার কাছে মনে হচ্ছিল এ সম্মান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ভারত সরকার আমার প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে, সম্মানিত করেছে আমার মুক্তিযোদ্ধা প্রিয় বাবাকে। বিএসএফ কর্মকর্তা মি. রাঠোর আমাকে একটি স্মৃতিসৌধে নিয়ে যান পুষ্পস্তবক অর্পণ করার জন্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৯ জন বিএসএফ সৈনিক আত্মাহুতি দিয়েছিলেন এই সীমান্ত শহরে। এই ৯ জন শহীদের সম্মানে তৈরি হয়েছে এই সৌধ। আমি বিনম্র শ্রদ্ধায় এই স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি এবং বিএসএফ সৈনিকদের দেওয়া গার্ড অব অনার গ্রহণ করি। রাতে বাঘমারা সার্কিট হাউসে রাতযাপনের পর পর দিন সকালে অত্যন্ত নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় মহেশখোলায়, যেখানে আমরা কাটিয়েছি আমাদের শরণার্থী জীবন। ৭৬ বছর বয়সী জালিন মারাক নামের একজন স্থানীয় গারো বাসিন্দা যিনি বাংলায় কথা বলতে পারেন, তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন কোথায় শরণার্থী ক্যাম্প ছিল, কোথায় ছিল যুব শিবির বা ইয়ুথ ক্যাম্প এবং কোথায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ছাউনি বা এফএফ ক্যাম্প। তিনি মাচার ওপর স্থাপিত নলখাগড়ার বেড়া দিয়ে তৈরি আমাদের আবাসস্থলটি কোন পাহাড়ের ওপর ছিল সেটিও দেখিয়েছিলেন। ঘণ্টাখানেক সেখানে অবস্থানের পর আমি তুরা জেলা শহরের উদ্দেশে রওনা হই এবং সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ সার্কিট হাউসে পৌঁছাই।

তুরা সার্কিট হাউসে রাতযাপনকালে সেখানকার জেলা জজ, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার আমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে ১৯৭১ সালের সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে তাদের জানার আগ্রহ আমাকে অনেকটাই বিস্মিত করেছে। কারণ এরা কেউই ১৯৭৫-এর আগে জন্মগ্রহণ করেননি। আমি যখন পরদিন দেশের উদ্দেশে ফিরে আসছিলাম, সীমান্তে বিএসএফের তুরা সেক্টরের ডিআইজি তার সৈনিকদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক সালাম প্রদর্শন করে আমাকে কিছু উপহারসামগ্রী দিয়েছিলেন। আমি ও আমার ভাই ভারতের মেঘালয় রাজ্য সরকারের দেওয়া আতিথেয়তা উপভোগ করেছিলাম। তাঁদের প্রতি আমরা যে কত ঋণী সেটা আমি বারবার অনুভব করেছিলাম, যেমনটি আমরা করেছিলাম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়, যখন আমাদের কোনো ধারণাও ছিল না, আমরা আদৌ স্বাধীন দেশে ফিরে আসতে পারব কি না।

অনেক স্মৃতি আর অনেক কথা আমার চার-পাঁচ মাসের শরণার্থী জীবনের। অল্প কিছু কথায় যা প্রকাশ করা বেশ কঠিন। আমার সহকর্মী দুই বিচারপতি জনাব এম. ইনায়েতুর রহিম ও জনাব কামরুল কাদেরেরও শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আজ পরম শ্রদ্ধায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বারবার হৃদয়পটে ভেসে আসছে। আর মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও লাখো বাঙালির আত্মত্যাগে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই আজ আমি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত। আর আমার দুই সহকর্মী জনাব এম. ইনায়েতুর রহিম ও জনাব কামরুল কাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা সুপ্রিম কোর্ট ইনার গার্ডেনে স্থাপন করেছি স্মৃতি চিরঞ্জীব নামক স্মারকস্তম্ভ। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে রচনা করেছিলেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশের সংবিধান। এই সংবিধানের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে ভাষণ প্রদানের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রার পথ অবারিত করেছিলেন তাঁর সেই অমূল্য স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সেখানে নির্মিত হয়েছে ‘স্মৃতি চিরঞ্জীব’। এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী অনেক আইনজীবীর নাম। এই ‘স্মৃতি চিরঞ্জীব’ স্মারকস্তম্ভটি উদ্বোধন করেছিলেন জাতির পিতার কন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর উদ্বোধনের পর থেকেই আমাদের সব বিচারক ও আইনজীবী এই স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী আইনজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছি।

জীবনের অনেক পর্ব অতিক্রম করলেও অর্ধশতাব্দী কালেরও বেশি আগে সেই শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতা বিস্মৃত হওয়ার নয়। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারালয়ে বসে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কিছু অসামাজিক কার্যকলাপের ঘটনা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তখন মনে হয় আমরা যারা এক সময় ভারতের মাটিতে শরণার্থী জীবন কাটিয়েছিলাম তখন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঙালি শরণার্থীরা সেদিন অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করার পরও নিজেদের সদা সর্বদা সংবরণ করে রেখেছে। কোনো রকম অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে তারা জড়িত হননি। সম্ভবত সব শরণার্থীই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিল বলেই বাঙালি জাতির মর্যাদা ও সম্মানের ক্ষতি হবে এমন কোনো কার্যকলাপের সঙ্গে তারা জড়িত হননি। এটি ছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের দেশপ্রেমের মূর্ত বহিঃপ্রকাশ।

লেখক : বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি

সর্বশেষ খবর