ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে ইংরেজ শাসনসৃষ্ট নবোত্থিত মধ্যবিত্ত বাঙালির মনন, অনুভূতি ও সাহিত্য-চেতনার জগতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে যারা ঋতি্বকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে মধুসূদনের ভূমিকা অসাধারণ। সাহিত্যে তার এই ভূমিকা নির্দেশ করে আধুনিক বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের পথিকৃৎ প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও কবি শশাঙ্কমোহন সেন লিখেছেন- "বঙ্গভাষায় এবং সাহিত্যে মধুসূদনের স্থান নির্দেশ করিতে হইলে বলা যায় যে, মধুসূদন দত্ত নামক একজন অসুর বলশালী 'টিটান' (Titan) বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি প্রমিথিউসের মতন স্বর্গ হইতে সারস্বত প্রতিভার অমর বহ্নিশিখা বাঙালির জন্য হরণ করিয়া আনিয়াছিলেন, তজ্জন্য তাহাকে ভাগ্যবিধাতার কঠোর দণ্ড গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। সমস্ত জীবন দুর্দশার পাষাণশৈলে শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকিয়া সেই মহাপুরুষ হীনতা স্বীকার করেন নাই, এই অগ্নির পরিহার করেন নাই।... মধুসূদনের হৃদয় মেঘের মত বজাগ্নিপূর্ণ, বারিপূর্ণ এবং ধ্বনিপূর্ণ ছিল; তিনি সেই অগ্নি, সেই জল এবং সেই ধ্বনি বঙ্গসাহিত্যে রাখিয়া গিয়াছেন! সেই মহামেঘের বর্ষণের পরেই বঙ্গদেশ শ্যামল, শস্যবৃক্ষে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।" তিনি আরও লিখেছেন, "একদিকে আর্য্যসাহিত্যের বাল্মীকি কালিদাস ভারবি এবং ভবভূতি, অন্যদিকে পাশ্চাত্য সাহিত্যের হোমার, ভার্জিল ওভিদ দান্তে টাসো মিলটন ও বায়রন প্রভৃতি প্রাণ-পৌরুষশালী কবিগণের পদতলে বসিয়াই মধুসূদন কবি-দীক্ষা গ্রহণ করেন। ... মধুসূদনের একটা স্বাভাবিক আভিজাত্য এবং সজীব গতি...
"রবীন্দ্রনাথকে মাথায় রেখেও বলা চলে, বাংলা ভাষায় প্রতীচ্য আদলের ও মানের সাহিত্য সমালোচনা প্রথম শুরু করেন কবিভাস্কর শশাঙ্কমোহন সেন (১৮৭২-১৯২৮), দ্বিতীয় ব্যক্তি মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২); তারপর আমরা শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ সেনগুপ্ত, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ বহু সমালোচক প্রাবন্ধিক পেয়েছি। সাহিত্যের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণমূলক ইতিহাসকার রূপে পেয়েছি দীনেশ চন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯), সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ এনামুল হক, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ। এদের অনেকেই সম্পূর্ণ কিংবা বিশেষ শাখার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণমূলক ইতিহাস রচনা করেছেন" (আহমেদ শরীফ, বিশ শতকে বাঙালী)। বিনয় কুমার সরকারও শশাঙ্কমোহনকে তুলনামূলক সমালোচনা সাহিত্যের পথপ্রদর্শক হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। প্রমথ বিশীর মতে, "মাইকেল সম্বন্ধে যতগুলি পুস্তক আছে (খুব বেশি নাই), তন্মধ্যে শশাঙ্কমোহন সেনের বইখানি শ্রেষ্ঠ" (প্রমথ বিশী, মাইকেল মধুসূদদন)। মধুসূদন সমালোচনায় শশাঙ্কমোহন সেনের ঋণ পরবর্তী প্রায় সব মুখ্য সমালোচক স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশের কোন কবি এখন যাবৎ বিস্তারিত কাব্যক্ষেত্রে মধুর এই স্বতন্ত্র অথচ দূর-সমুন্নত স্বাভাবিকতার সমীপবর্ত্তী হইতে পারেন নাই।" (শশাঙ্কমোহন সেন, বঙ্গবাণী)।একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দাঁড়িয়ে গত দেড়শ' বছরের বাঙালির সাহিত্য অর্জনের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, তাহলে দেখব প্রায় একশ' বছর আগে শশাঙ্কমোহন যে-কথা বলেছিলেন তা আজও সত্য। বিস্তারিত কাব্যক্ষেত্রে, বিশেষত মেঘনাদ বধ কাব্যে, মধুসূদন যে ক্লাসিক বা ধ্রুপদী আভিজাত্য সৃষ্টি করেছিলেন তা আজও অনধিগম্যই থেকে গেছে। রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা' অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা একটি বচনাতীত সৌন্দর্যর্ের রোমান্টিক কাব্য, রোমান্টিকতায় তার তুলনা কেবল কালিদাসের 'মেঘদূত'। কিন্তু অনির্বচনীয় মাধুর্য সত্ত্বেও এ কাব্যে 'মেঘনাদ বধ' কাব্যের সেই অসাধারণ আভিজাত্য নেই। অবশ্য, তার প্রয়োজনও নেই; কারণ দু'জনের কবি-ধর্ম আলাদা। একজন জন্ম রোমান্টিক, অপরজন কবিতার সেই পথের পথিক যা রাজবর্ত্দ, ক্লাসিকাল (অবশ্য তার মধ্যে রোমান্টিকতাও মিশে রয়েছে)। সাহিত্য চারিত্র্যের এই ভিন্নতার কারণেই রবীন্দ্রনাথ তার প্রথম জীবনে মধু-কবির সঙ্গে একাত্দতা অনুভব করতে পারেননি, 'ভারতী'তে এই মহাকবির অযৌক্তিক সমালোচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে মেঘনাদ বধ-এর গগনস্পর্শী আভিজাত্য ও ঋজুতা এবং মধুসূদন যে এমন এক উত্তমর্ণ যার ঋণ বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য কোনোদিন পরিশোধ করতে পারবে না তা উপলব্ধি করে লিখেছিলেন, "তিনি স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির প্রচণ্ড লীলার মধ্যে আনন্দ বোধ করিয়াছেন। এই শক্তির চারিদিকে প্রভূত ঐশ্বর্য; ইহার হর্ম্যচূড়া মেঘের পথ রোধ করিয়াছে; ইহার রথ-রথি-অশ্ব-গজে পৃথিবী কম্পমান; যে অটল শক্তি ভয়ঙ্কর সর্বনাশের মাঝখানে বসিয়াও কোনমতেই হার মানিতে চাহিতেছে না, কবি সেই ধর্মবিদ্রোহী মহাদম্ভের পরাভবে সমুদ্রতীরের শ্মশানে দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলিয়া কাব্যের উপসংহার করিয়াছেন। যে শক্তি অতি সাবধানে সমস্তই মানিয়া চলে তাহাকে যেন মনে মনে অবজ্ঞা করিয়া যে-শক্তি স্পর্ধাভরে কিছুই মানিতে চায় না, বিদায়কালে কাব্যলক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালাখানি তাহারই গলায় পরাইয়া দিল।" ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মধ্যেও যে অটল শক্তির কথা কবি বলেছেন, তা কি কেবল রাবণ, মধুসূদন নিজেও কি নন?
বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও কাব্য সাধনা শুরুর অব্যবহিত আগে মধুসূদনের জীবনে বিরাট সব ভূকম্পন ঘটেছিল। তার পিতৃ-মাতৃ-বিয়োগ, প্রথম স্ত্রী রেবেকাকে মাদ্রাজে ফেলে রেখে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে হেনরিয়েটাকে গ্রহণ, পিতৃ-সম্পত্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা, এক কথায় জীবনের টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই মধুসূদন বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতার দীক্ষা দেওয়ার জন্য এগিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার মতো যোগ্যতা একাধারে বিরাট কবি প্রতিভা এবং সেই প্রতিভাকে বিকশিত করার জন্য বিশ্বসাহিত্যের মহত্তম কবি প্রতিভাদের সঙ্গে আত্দিক পরিচয় আর কারো ছিল না। বিশপস কলেজে থাকার সময় (১৮৪৩-৪৭) তিনি গ্রিক, হিব্রু ও ল্যাটিন শিখেছিলেন। ইংরেজি ভাষার মিলটন, শেকসপিয়র, বায়রন প্রমুখ কবিরা ছিলেন তার মনের নিত্যসঙ্গী। কেবলমাত্র এরাই নন, হোমার, ভার্জিল, ওভিদ, টাসো ও দান্তেকেও তিনি আত্দস্থ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে ও পরে আর কি কেউ এরকম বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে সচেতনভাবে সাহিত্য-সাধনায় আত্দনিয়োগ করেছেন? আমরা অনেকেই জানি, তিনি হঠাৎ করে বাজি ধরে অমিত্রাক্ষর রচনা করে বাংলা কবিতার পয়ার ও লাচারীর বদ্ধ-জলাভূমির বাঁধ ভেঙেছিলেন। এই সত্য অনুধাবন করা দরকার, ঐ কাজ কোনো দিনই তার পক্ষে করা সম্ভব হতো না যদি না তিনি বিভিন্ন ভাষায় কবিতার ধ্বনিগৌরবে তার কানকে সিদ্ধ ও ঋদ্ধ করতেন! গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃতি প্রাচীন আর্যভাষা। ইংরেজি ও বাংলা এই ভাষাসমূহেরই দুহিতা। বাংলা ছাড়া আর চারটি ভাষায় যদি অন্তমিল অপরিহার্য না হয়, তাহলে বাংলায় কেন তা হবে? এই বোধই মধুসূদনকে প্রেরণা জুগিয়েছিল অমিত্রাক্ষর ছন্দের ধ্বনিগৌরব বাংলায় প্রতিষ্ঠা করতে। মনে রাখা প্রয়োজন, এর আগে তিনি ইংরেজি অমিত্রাক্ষরে কাব্য ও কবিতা রচনা করে এই ছন্দের অন্তর্নিহিত ধ্বনি ছন্দকে আত্দস্থ করেছিলেন। সুতরাং বাংলা কাব্য তার পায়ের শৃঙ্খল-ভাঙার জন্য, তার সাহিত্য-গগনকে আগুনের পরশমণিতে আলোকিত করার জন্য যে-প্রমিথিউসের অপেক্ষা করেছিল, শশাঙ্কমোহন যথার্থই বলেছেন, সেই প্রমিথিউস মধুসূদন। এই আগুন-জ্বালানোর জন্য সব রকমের প্রস্তুতি নিয়েই মধুসূদন এগিয়েছিলেন। জীবনের সব ঝড়-ঝঞ্ঝা ও বিপর্যয়ের মধ্যেও তার সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব অবিচল ও স্থিতধী ছিল।
বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর মতো মহৎ রোমান্টিক চেতনার কবিতা রচিত হলেও, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগের ধর্মবোধ ও চরিত্র-সৃষ্টির কৃত্রিম বেড়াকে অতিক্রম করতে পারেনি। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, অমিত সম্ভাবনায় ভাস্বর, স্বাধীনতা বোধে উজ্জীবিত যে-মানুষ, সে-মানুষের পরিচয় আমরা প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যে মাঝে মাঝে পাই। ইউরোপের রেনেসাঁস সাহিত্য সে-বোধকে আরও নানা বর্ণচ্ছটায়, নতুন জীবনবোধে, নারী-পুরুষের সম্পর্ককে দেহাতীত প্রেমের অমর্ত্য-চেতনায় উৎকণ্ঠিত ও আলোড়িত করে অন্য এক স্তরে নিয়ে স্থাপন করেছিল, বাংলা সাহিত্যকে সেই স্তরে উন্নীত করার যোগ্যতা ও প্রস্তুতি একমাত্র মধুসূদনেরই ছিল। রেনেসাঁসের মহৎ কবিদের দান্তে মার্লো পেত্রার্ক শেঙ্পীয়র ও মিল্টনের কাব্যের আভিজাত্য ও চিত্ত সমুন্নতি মর্মে মর্মে উপলব্ধি ও আত্দস্থ করতে না পারলে তা কোনোদিনই সম্ভব হতো না।
১৮৪৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' অনুবাদ করে আধুনিক বাংলা গদ্যের সূচনা করলেও আধুনিক মানসের পরিচয় বহনকারী প্রথম বাংলা উপন্যাস 'দুর্গেশ নন্দিনী' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এই উপন্যাসের প্রকৃত নায়িকা আয়েশার মধ্যে যে দেহাতীত প্রেমের পরিচয় আমরা পাই, তার প্রাক-অনুভূতি ও পথনির্দেশ কি আমরা মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্যের বীরাঙ্গনাদের মধ্যে দেখি না!
মধুসূদন তার সাহিত্য-চেতনাকে তার ব্যক্তি-জীবনেও প্রসারিত করেছিলেন। তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়নি মা-বাবার নির্বাচিত একটি অপরূপা সুন্দরী বালিকাকে বিয়ে করা, এই বিষয়টিই তাকে তার মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল, তাকে খ্রিস্টান করেছিল। রেনেসাঁস থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ইউরোপীয় সাহিত্যের বিয়াত্রিচ, লরা, পেনিলোপি রিচ, ক্লিউপেট্রা, ডেসডিমোনা এবং প্রাচীন ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের সীতা, তারা, দ্রৌপদী, জনা প্রভৃতি স্বাধিকার-চেতনায় উদ্দীপ্ত নারীরা তার কবিচৈতন্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ভারতের ইতিহাসের একমাত্র নারী-সম্রাজ্ঞী রিজিয়াকে নিয়েও তিনি ইংরেজিতে একটি খণ্ড-নাট্যকাব্য লিখেছিলেন। রেবেকা ও হেনরিয়েটার মধ্যে তিনি এদেরই আদলে গড়া মানসসুন্দরীকে খুঁজেছেন।
মধুসূদন ইউরোপীয় রেনেসাঁস কবিদের মতো বাংলা সাহিত্যে ব্যক্তি-চেতনায় প্রবুদ্ধ যে নব মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সেখানে রেনেসাঁস কবিদের মতো তারও মাধ্যম হয়েছিল ধ্রুপদী সাহিত্যের মহিমান্বিত চরিত্ররা। বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্যকে সচেতনভাবেই তিনি সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন নতুন নাট্যধারা, চরিত্রসৃষ্টি ও তার অনুষঙ্গ ভাষা তৈরির মাধ্যমে, যার প্রকাশ তার প্রথম সৃষ্টি শর্মিষ্ঠাতেই পরিস্ফুট। শর্মিষ্ঠার প্রস্তাবনায় তিনি লিখেছিলেন, 'অলীক কু নাট্য রঙ্গে, মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।'
সমৃদ্ধ ইউরোপীয় সাহিত্যে মগ্নচিত্ত একজন প্রতিভাবান স ষ্টা, যিনি বাংলা ভাষার সম্ভাবনায় ধীরে ধীরে জেগে উঠছেন তার জন্য তৎকালীন বাংলা নাটকের এই দৈন্য কী অসীম পীড়াদায়ক হয়েছিল, এই উক্তিতে তা ফুটে উঠেছে।
ধ্রুপদী প্রাচ্য-রীতির সঙ্গে পাশ্চাত্য-রীতির সংমিশ্রণেই শর্মিষ্ঠার সৃষ্টি। বহিরঙ্গে তিনি প্রাচীন সংস্কৃতি নাটকের সব রীতিকে বর্জন করেছিলেন। শর্মিষ্ঠার আঙ্গিক পাশ্চাত্য রীতির; এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ''Remember, that I am writing for that portion of my countrymen who think as I think. Whose minds have been more or less imbued with western ideas and modes of thinking; and that is my intention to throw off the fetters forged for us by a servile admiration of everything Sanskrit'' কিন্তু শর্মিষ্ঠা সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য ভাবধারার নাটক নয়। পাশ্চাত্যে পুরুষ বা নারী কারো একাধিক স্ত্রী বা স্বামী থাকে না। শর্মিষ্ঠা নাটকে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর সপত্নী। এই নাটকে দুজন সপত্নীর মধ্যে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা ও যযাতীর যে দ্বিচারী প্রেম দেখানো হয়েছে, তা প্রাচ্য-ভাবধারারই। কবির নিজের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা এখানে সূক্ষ্মভাবে কাজ করে থাকতে পারে, যদিও তিনি রেবেকাকে ত্যাগ করেই হেনরিয়েটাকে জীবনসঙ্গিনী করেছিলেন। ১৮৬০ এর এপ্রিলে প্রকাশিত পদ্মাবতী নাটকে গ্রিক অদৃষ্টবাদ বা Fate এবং গ্রিক মিথ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মধুসূদন কেবল বিদেশি ভাবধারার দেশীয় অঙ্গীকরণের চেষ্টাই করেননি, মেঘনাদ বধ কাব্যের জন্য তৈরিও হচ্ছিলেন। এই প্রস্তুতি নঙর্থের দিক থেকে। পদ্মাবতীর কোনো চরিত্রেই মানুষের ইচ্ছাশক্তি জয়ী নয়; সব চরিত্রই যেন অদৃষ্টের হাতের ক্রীড়নক, পুতুল মাত্র। পদ্মাবতীতে মানুষের আত্দসমর্পণ থেকে মেঘনাদ বধে আত্দশক্তির সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অটল-থাকার, জয়ী-থাকার যে-ঘোষণা তা এক বিরাট উলম্ফন বা পথপরিক্রমা।
শর্মিষ্ঠাতেই মধুসূদন বাংলা নাটকের ভাষা নির্মাণের চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন। সে-চেষ্টা কৃষ্ণ কুমারীতে পূর্ণতা পেয়েছে। "কৃষ্ণ কুমারীর ভাষার মধ্যে মধুসূদন বঙ্গভাষার যে গার্হস্থ্যশক্তি, যে গ্রাম্যতাবর্জিত অথচ 'আটপৌরে'-সামর্থ্য আয়ত্ত করিয়াছেন, তাহাও সর্বতোভাবে অপূর্ব!" (শশাঙ্কমোহন, মধুসূদন)
নাটকের ভাষা নিয়ে মধুসূদনের সুগভীর চিন্তার বাহন তার চিঠিগুলো। এগুলো প্রমাণ করে নাটকের কী গভীর মর্মমূলে তিনি ঢুকেছিলেন। তার রচিত 'একেই কি বলে সভ্যতা' ও 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ'- এই দুটি প্রহসন লেখা ও প্রকাশ করার পর তিনি রাজ নারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন, 'I half regret having published these two things.' তিনি আরও লিখেছিলেন you know that as yet we have not established a National Theatre. I mean we have not as yet got a body of sound classical Dramas to regulate the National taste, therefore we ought not to have Farces' সাহিত্যে, নাটকে জাতীয় রুচি সৃষ্টি করার ব্যাপারে কী গভীর সচেতনতা! তার এই সংকোচ সত্ত্বেও আমরা জানি প্রহসনের ক্ষেত্রে তিনি এখনো অনতিক্রমই থেকে গেছেন। মধুসূদনের সব লেখার মধ্যেই তৎকালীন সমাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিদ্রোহ আছে। তিনি ঘুণেধরা সমাজের, যে সমাজ প্রতিপদে মানুষের সম্ভাবনাকে পিষে মারতে চায়, হত্যা করে, তার অবসান চেয়েছেন। এই প্রহসন দুটোতে তিনি সমাজের দুই প্রান্তের তথাকথিত ধার্মিক রক্ষণশীল ও বিলেতি-সভ্যতার বহিরঙ্গে আকৃষ্ট ভণ্ডদের এমন সুতীব্র কষাঘাত করেছিলেন যে, তাদের প্রতিকূলতার জন্য সে সময় এই প্রহসন দুটো মঞ্চস্থ করাও সম্ভব হয়নি (আজো কি আমাদের সমাজে এরা নেই!)। মধুসূদন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম স্রষ্টা হলেও তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তরঙ্গের ঐশ্বর্যেরই উপাসক ছিলেন, তাদের বহিরঙ্গের উচ্ছৃঙ্খলতার প্রতি তার ঘৃণাই ছিল। ডিরোজিওর প্রত্যক্ষ ছাত্র না হলেও তিনি ডিরোজিওর নৈতিক ছাত্র ছিলেন। 'বুড়ো শালিক' নাটকে তিনি শোষিত মানুষের প্রতিনিধি, স্বাভাবিক সুস্থ জীবনের জন্য পিপাসার্ত হানিফ গাজী ও তার স্ত্রী ফাতেমাকে জয়ী করে মানবতাকেই জয়ী করেছেন।
শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী, তিলোত্তমা, মেঘনাদ বধ, বীরাঙ্গনায় যে ব্যক্তি সচেতনভাবে মহৎ বিষয়ের বাহন হিসেবে ভাষাকে সমুন্নত আভিজাত্য দিতে চেয়েছেন, সেই একই ব্যক্তি কি 'একেই কি বলে সভ্যতা' ও 'বুড়ো শালিকে' অপূর্ব দক্ষতায় ভাষাকে ব্রাত্যজনের বাহন করেননি? ব্রজাঙ্গনায় তাকেই আবার নির্ঝরের কুলু কুলু ধ্বনিতে রূপান্তরিত করেছেন। ভাষা ও সাহিত্যের এই সব্যসাচী সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে লক্ষ্য ভেদ করে শুরু থেকেই বাংলা সাহিত্যকে অনন্য বৈশিষ্ট্যে ও অপার সম্ভাবনায় মূর্ত করেছেন।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম সার্থক প্রকাশ তিলোত্তমায়। তিল তিল সুন্দর দিয়ে গড়া এই সুন্দরের প্রতিমা বাঙালির নবজীবনের ভোরে কেবলমাত্র মহাসমুদ্রের তরঙ্গ ছন্দের মহাকল্লোলই বাঙালিকে শোনায়নি, একই সঙ্গে তাকে নির্বূ্যঢ় সুন্দরের তৃষ্ণায়ও উৎকণ্ঠিত করেছে।
এ ক্ষেত্রে কালিদাসের মেঘদূত ও কিটসের এন্ডাইমিয়ন ও রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদায় তিলোত্তমার কিছুটা পূর্বাভাস ও উত্তরাভাস মেলে। তিলোত্তমার পরেই মেঘনাদ বধ। এই মহাকাব্য লেখার আগে রাজ নারায়ণ বসু জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালির সিংহল বিজয়ের কাহিনী নিয়ে কাব্য রচনার জন্য কবিকে অনুরোধ করেছিলেন। সিংহল বিজয়ের তথ্য দিয়ে একটি নকশাও তৈরি করে দিয়েছিলেন। কবি নিজেও একটি নকশা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিংহল বিজয় লিখতে পারেননি; মন প্রস্তুত নয় বলেই তিনি জানিয়েছিলেন। এটাই তো স্বাভাবিক। তার অবচেতন মনে পরাধীনতার গ্লানি ছিল। এই গ্লানি নিয়ে বিজয়ের আনন্দের গান তিনি কীভাবে গাইবেন? তাই 'গাইব, মা, বীররসে ভাসি, মহাগীত' বললেও তিনি যে গান গাইলেন, যে মহাকাব্য রচনা করলেন, তা দুর্নিবার প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অপরাজেয় মানুষের সংগ্রাম ও নিজেকে এক অপ্রতিরোধ্য নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার মহাগীত বা মহাকাব্য। তাই এই মহাকাব্য শেষ হয়েছে এক মর্মভেদী হাহাকারের মধ্য দিয়ে। মেঘনাদ বধ কাব্যই বাঙালির প্রকৃত এবং একমাত্র মহাকাব্য। এই মহাকাব্য একই সঙ্গে ক্লাসিক ও রোমান্টিক। সম্পূর্ণ রোমান্টিক উপাদানবিহীন মহাকাব্য নেই বললেই চলে। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়ড, ইনিড, ওডেসি প্রতিটি মহাকাব্যের শেষেই একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস আছে। মিলটনের প্যারাডাইস লস্টে হয়তো তা সবচেয়ে কম। তবুও রিপাবলিক চেতনায়, গণতান্ত্রিক বোধে উদ্দীপ্ত কবি ঝধঃধহ এর মুখ দিয়ে কি এ কথা উচ্চারণ করাননি; 'It is better to reign in the Hell than to serve in the Heaven.' একই বোধ মধু কবির হৃদয়েও অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো প্রবাহিত ছিল। তাই বিজয়ের গান কবি গাইতে না পারলেও স্বাধীনতাহীন বাঙালিকে কবি অনম্য মেরুদণ্ডী রাবণের মধ্য দিয়ে মহাধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অপরাজিত থাকার দীক্ষা দিয়েছিলেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ