সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

চিন্তা কর বেশি, বল অল্প এবং লেখ তার চেয়েও কম

রণক ইকরাম

চিন্তা কর বেশি, বল অল্প এবং লেখ তার চেয়েও কম

হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন— ‘বিরক্তিকর কোনো মানুষ ফ্রড হতে পারে না। পৃথিবীতে ফ্রড মাত্রই ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার হয়।’ এমনই এক ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টারের সঙ্গে বইমেলায় দেখা। তবে সে ‘ফ্রড’ নয়, লেখক। এই মেলাতেই তার প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বই বেরিয়েছে। মানে মাঠে নেমেই হ্যাটট্রিক। বইগুলো নাকি হটকেকের মতোই চলছে। মেলা প্রাঙ্গণে তার বইয়ের ব্যানার-ফেস্টুন ইত্যাদি চোখে পড়ার মতো। ইনিয়ে-বিনিয়ে তার বইয়ের স্টলের সামনে নিয়ে গেল। উদ্দেশ্য আমাকে দিয়ে তার বই কেনানো। মুখে সেটা না বললেও আচার-আচরণে তার এই আকুতি ভীষণ স্পষ্ট। বইটার কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়েই যা বোঝার বুঝে গেলাম। কয়েকটা কবিতা (?), দুটো গল্প আর অনেকগুলো ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে বই! আমি বইটা স্টলে ফেরত দিতেই সে বলল, ‘ভাই নেবেন না।’ আমি মিথ্যে বললাম, ‘আজ না। আরেক দিন।’ তাকে কিঞ্চিৎ হতাশ দেখে জিজ্ঞেস করলাম এত প্রচারণা কেন? জবাবে সে জানাল আওয়াজ না দিলে নাকি চলেই না। বই যা চলার প্রচার আর আওয়াজেই চলে। জবাবে আমি কেবল ‘হু’ বললাম। মাথার ভিতর তখন একটা প্রাসঙ্গিক জোকস মনে পড়ে গেল। ছেলে বাবাকে জিজ্ঞেস করছে— বাবা, আমাদের বিজ্ঞানের স্যার বলেছেন, ‘অক্সিজেন ছাড়া আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারি না। কিন্তু অক্সিজেন আবিষ্কৃৃত হয়েছে ১৭৭০ সালে। তাহলে তার আগে কি কেউ নিঃশ্বাস নিত না?’ বাবা একটু বিপদেই পড়ে গেলেন। কথা না বাড়িয়ে তিনি শর্টকাটে উত্তর দিলেন, ‘না, কারণ মানুষের নাকও ওই বছরই তৈরি হয়েছিল!’

কিন্তু বই লেখা তো স্রেফ এই আমলে তৈরি হয়নি। তাহলে এত প্রচার কেন লাগবে? তাই বলে প্রচারের বিরোধিতা আমি করছি না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও কিন্তু বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছিলেন। তবে নিশ্চয়ই সেটা বুঝে শুনেই। নইলে তিনি কেন বলবেন—

‘চন্দ্রের যা কলঙ্ক সেটা কেবল মুখের উপরে, তার জ্যোত্স্নায় কোনো দাগ পড়ে না।’ কিন্তু অতিরিক্ত প্রচারের আলোয় থাকা তথাকথিত হিট বইগুলোর ভিতরে কতটুকু জোছনা আর কতটুকু দাগ থাকে, নাকি পুরোটাই অন্ধকার সেটা একটা গবেষণার বিষয়। তাই আবারও হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে হয়— ‘নিজের সার্টিফিকেট নিজেই দিও না। খেয়াল করে দেখ যে, সবাই তোমাকে কী ভাবে। তাদের কাছেই সার্টিফিকেট নাও। নিজের সমালোচনা করেই দেখ না, শুদ্ধ হওয়া কঠিন কিছু না।’

বলা হয়ে থাকে, ভাগ্য সবার দুয়ারে আসার জন্যই অপেক্ষা করে, কিন্তু উপযাচক হয়ে আসে না, ডেকে আনতে হয়। আর ডেকে আনার সেই কাজটা করতে হয় অতি সন্তর্পণে, বুঝে শুনে। হুটহাট অযাচিত কিছু করলেই হয় না। আগুন দিয়ে যেমন লোহা চেনা যায়, তেমনি মেধা দিয়ে মানুষ চেনা যায়। সেই মেধা নিয়ে দোকানদারি করার আগে ভেবে নেওয়াই উত্তম। ভুলে গেলে চলবে না ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ কথা দুটো সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে ছোট।

কিন্তু এ কথা দুটো বলতেই সবচেয়ে বেশি ভাবতে হয়। আর কখনো কখনো না বলতে পারার মধ্যেও সার্থকতা নিহিত থাকে। জন রে যেমন বলে গেছেন, ‘চিন্তা কর বেশি, বল অল্প এবং লেখ তার চেয়েও কম।’

দুই বন্ধুর মধ্যে কথা হচ্ছে— প্রথমজন বলল, ‘দোস্ত, তুই তো গান গাইতে পারিস না তাহলে যখন তখন এমন গলা সাধানো শুরু করিস কেন?’

বন্ধু জবাবে বলল, ‘আরে আমি তো গাইতে চাই না। আসলে যখন অতিথি বিদায় করার দরকার পড়ে তখনই আমাকে গাইতে বলা হয়। এখন সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।’

আমার জানার খুব ইচ্ছা হুটহাট গজিয়ে ওঠা লেখকদের এভাবে ছাইপাশ লিখে পাঠক বিদায় করার ঠিকাদারিটা আসলে কে দিল? বড্ড বেশিই বলে ফেলেছি। সব সময় সব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে নেই। কী রকম? ওই ডার্টি জোকসটার মতো।

কমলালেবু, আখরোট, মাশরুম আর কলা মিলে খাবার টেবিলে আড্ডা দিচ্ছে।

কমলালেবু বলল, ‘আমি দেখতে একদম ক্রিকেট বলের মতো। লোকজন আমায় কত্তো ভালোবাসে!’ শুনে হাসলো মাশরুম। বলল, ‘আমি দেখতে একদম ছাতার মতো। বিপদে-আপদে মানুষকে কত

সাহায্য করি!’ আখরোটও কম যায় না। তার উক্তি, ‘আমি দেখতে একদম মানুষের মস্তিষ্কের মতো। দুনিয়ার সব কাজ তো আমিই করি!’ সব শুনে দারুণ বিব্রত এবং অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে কলা। জবাব দিল, ‘আরে ভাই তোমাদের সমস্যা কি? এমন অদ্ভুত বিষয় নিয়ে কথা বলা বন্ধ কর না!’

সর্বশেষ খবর