সোমবার, ৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুখ ও কথার সাইজ

আফরীন সুমু

মুখ ও কথার সাইজ

বাবার বন্ধু এসেছেন। বাবা খাচ্ছেন। আমাকে বললেন, পেপারটা হাতে নিয়ে বসতে বল। আমি তাই করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মা নাশতা দিয়ে পাঠালেন। আঙ্কেল পেপার নামিয়ে তাকালেন আমার দিকে। পাঁচ নম্বর পাতা থেকে একটা লেখা দেখিয়ে বললেন, খাসা লিখেছে তাই না? আঙ্কেল ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসছেন। তাকিয়ে দেখলাম উনি আমার আজকের ছাপা হওয়া রম্যটার কথা বলছেন। নিজের পরিচয় দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না। ছোট্ট করে বললাম, আঙ্কেল ওটা আমি লিখেছি। উনি মনে হলো শুনতে পাননি। উঠতি লেখক হিসেবে বিষয়টা আমার জন্য বড়ই লজ্জার। গলা খাঁকারি দিয়ে একটু জোরে আবার বললাম। এবার আঙ্কেল ফিরে তাকালেন। হাসি বন্ধ হয়েছে। মনে হলো লেখায় রস কমে গিয়েছে। একজন অল্পবয়সী লেখকের সামনে তার লেখা পড়ে হাসবেন এটা বোধহয় আঙ্কেলের ঠিক পছন্দ নয়। পেপার বন্ধ করে উনি আমার পড়াশোনার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন। কী প্রসঙ্গে যেন রবীন্দ্রনাথের কথা এলো। ছেলেবেলায় উনি যে কত রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন তার ফিরিস্তি দিলেন। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে কবিতার দুটি লাইন শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পড়েছি কিনা এই কবিতা। আমার জবাবের তোয়াক্কা উনি করেন না। আলোচনা শুরু হলো উচ্চমার্গীয় সাহিত্য নিয়ে। দেখা গেল উনি নজরুলও পড়েছেন। লিচু চোর কবিতাটি একসময় উনার ঝরঝরে মুখস্থ ছিল। সাহিত্য আসলে খুবই গভীর বিষয়। এর মর্ম সবাই বোঝে না। আমার ধারণা, উনি রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ব্যতীত আর কোনো কবি-সাহিত্যিকের নামই শোনেননি। যাই হোক, আলোচনা ঘুরেফিরে আবার আমার পড়াশোনায় এসে ঠেকল। আমি জানালাম সদ্য অনার্স শেষ করেছি। উনি কিছুটা আশাহত হলেন। কারণ একজন অনার্স শেষ করা ছাত্রকে বলা যায় না মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। মাস্টার্সের খবর জিজ্ঞেস করলেন। তারপর আসলেন চাকরি-বাকরি প্রসঙ্গে। চাকরির প্রসঙ্গে আজকাল অবধারিতভাবে বিসিএস প্রসঙ্গ চলে আসে। সেই হিসেবে উনিও প্রসঙ্গটি মিস করলেন না। আমি জানালাম, বাবা চাচ্ছেন, তাই চেষ্টা করে দেখব। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলেন আঙ্কেল। বলতে শুরু করলেন, মন দিয়ে পড়বে। নইলে কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু করতে পারবে না জীবনে। আর এসব ছাইপাশ লিখে কী হবে? কেবলই সময় নষ্ট। সাহিত্য দিয়ে হয়টা কী? ছেলেপুলের মাথা নষ্ট কেবল। দিনরাত পড়াশোনা বাদ দিয়ে আজেবাজে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। যাকে তাকে দিয়ে এসব হয় না বুঝলে। যদি হতোই তবে ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথ পাওয়া যেত। রবীন্দ্রনাথ কি সবাই হবে? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলাম। জি না আঙ্কেল। রবীন্দ্রনাথ সবাই হবে না। এমনকি রবীন্দ্রনাথও আজ রবীন্দ্রনাথ হতেন না যদি উনার বাবার আপনার মতো একজন বন্ধু থাকত। কয়েক মুহূর্ত লাগল উনার কথাটা বুঝতে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে তুমি? বুঝলাম গুলি ফসকে গেছে। আমি কেটে পড়ার সুযোগ খুঁজছি। বললাম, কিছু না আঙ্কেল। আপনি বসুন আমি বাবাকে ডাকছি।

এরপর অনেক কিছু হলো। আমি ভিতর ঘর থেকে শুনতে পেলাম আঙ্কেল উচ্চৈঃস্বরে বাবার কাছে আমার সুনাম গাইছেন। অনেক কথার মধ্যে আরও একটা কথা কানে এলো। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! ভেবেছে কী সে, আমি রবীন্দ্রনাথ বুঝি না...। আমি হাসলাম। ঠিক যে কথাটি আমি মনে মনে ভাবছি সেটাই উনি জোরে জোরে শুনিয়ে দিলেন।

তবে যাওয়ার আগে আমি মাফটাফ চেয়ে নিয়েছিলাম। বাবা আমার হয়ে সাফাই গাইলেন। এরপর থেকে আমি গুরুজনের কথা শুনব এবং ছাইপাশ বাদ দিয়ে বিসিএসের জন্য মন দিয়ে পড়ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর