শিরোনাম
শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

কেউ পড়ে কেউ পড়ে না

কে জি মোস্তফা

কেউ পড়ুক বা না পড়ুক তাতে কী আসে যায় । না, অনেক কিছু এসে যায়। বিশ্ববিশ্রুত মনীষী লেখক লিও তলস্তয় বলেছেন, জীবনের জন্য তিনটি জিনিস অত্যাবশ্যক। ১. বই ২. বই ৩. বই। তবে যে যাই বলুক, সময় কাটানোর জন্য গল্প উপন্যাস পড়া কালের নিয়মেই যেন দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যদিও বইয়ের বাজারে উপন্যাসিকদের খাতি এখনো সর্বাধিক, কিন্তু পাঠ-অভিজ্ঞতা আমাদের বলে দেয়, এখনকার বেশির ভাগ বই শিল্পরসহীন, একঘেয়ে ক্লান্তিকর। ভিতরের আবেগের জায়গাটাকে মানে 'আমি'-কে সেভাবে ছুঁতে পারে না। অপরদিকে ছাপার ভুলের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই 'র' ও 'ড়'-এর কোনো তফাৎ থাকে না। 'বই পরা' আর 'জামা পড়া'-র মতো ভুল হর- হামেশাই দেখা যায়।

প্রসঙ্গত, মুদ্রিত গ্রন্থের আয়ু মাত্র কয়েক শতাব্দী, তার আগে ছিল হস্তলিপির পুঁথি। মুদ্রণশিল্পের প্রয়োজনীয়তা যখন উচ্চচূড়ায়, তারই মধ্যে গত শতকের শেষ দশকে হঠাৎ শোনা গেল, ছাপাখানা ও প্রকাশনা নির্ভর বইয়ের দিন শেষ হয়ে আসছে। গ্রন্থবিহীন সব রকম রচনা এখন প্রকাশের দায়িত্ব নিচ্ছে কম্পিউটার। যদিও গ্রন্থের মৃত্যু সম্পর্কে এমন সতর্কবাণী এখনো তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। কেননা মুদ্রিত বইয়ের সংখ্যা একটুও কমছে না। যারা নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন সেরকম অনেক মানুষের কাছে এখনো প্রিয় লেখকের বই অনেক বেশি প্রিয়। নিরালায় বসে একটি কাব্যগ্রন্থ পাঠের যে আনন্দ, তা কখনো কম্পিউটার থেকে পাওয়া যেতে পারে না। আমাদের বাংলাভাষায় অদূর ভবিষ্যতে কম্পিউটারের এই আগ্রাসনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

আসলে শিক্ষা বিস্তারের প্রধান মাধ্যম মুদ্রিত গ্রন্থ। গত দুটি শতাব্দীতে যেমনভাবে মানুষ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে, আগের যুগে তা ছিল কল্পনারও অতীত। প্রাথমিক শিক্ষার উপাদান থেকে সর্বোচ্চ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ফসল গ্রন্থের পৃষ্ঠাতেই বিধৃত।

আমাদের কৈশোর-যৌবনে বই-ই ছিল বিনোদনের একমাত্র উপকরণ। তারুণ্যের স্পর্ধায় টগবগ, সেই স্পর্ধা ভাষায়, বিন্যাসের কৌশলে চিন্তাকে উসকে দিয়ে সাজিয়ে নেবার আশ্চর্য কৌশল। সে সব বইয়ে ঘুরেফিরে আসত আমাদের শৈশব-কৈশোর, নিবিড় নির্জন প্রকৃতি। কখনো পার্বত্য শহর কিংবা অরণ্য, কখনো আটপৌরে গ্রামগঞ্জ কিংবা দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের বেলাভূমি। অধরা প্রকৃতির হাতছানি প্রাণ-মনকে টেনে নিয়ে যেত ঘরের বাইরে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু বই ভেতরের জগৎটাকে দিত আমূল বদলে। যাকে বলে মধুরেন সমাপয়েৎ!

ইদানীং অবশ্য বিদেশি লেখকরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। তাদের উপন্যাসে গবেষক সত্তা এসে মিশে যাচ্ছে লেখক-সত্তায়। নতুন প্রজন্মের পাঠক স্বাগত জানাচ্ছেন এ সব উপন্যাসকে। নতুন পাঠকদের জন্য ঝুঁকি নিতে জানা এমন নতুন সাহিত্যিকেরও আবির্ভাব ঘটছে নিয়ত। কারও কারও উপন্যাস যেন মাটির জীবনগাঁথা। ভূগোল, ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং মানবিক সম্পর্কের গভীর উপাখ্যান। যা কেবল ভেবে-ভেবে পড়তে হয়। কোথাও কোথাও কবিতার অনিশ্চিত যাত্রা যেন আয়ত্ব করছে নব্য উপন্যাস। জ্ঞান, না সুখ? কী চাই আমরা! তবে সযত্ন চেতনাময় পাঠের জন্য একেবারে সঠিক বইটি নির্বাচন করা দরকার।

বলাবাহুল্য আমাদের জীবনে এখন বিশ্বায়নের ছাপ লেগেছে। টেলিভিশন, ভিডিও, ইন্টারনেট, ফেসবুকের দৌলতে বিনোদনের উপকরণের অভাব নেই।

তবু বলব, বই হলো বিনোদনের সব চেয়ে বড় উপকরণ। গল্প-উপন্যাসে বাস্তব থাকে, একটু বেশিই থাকে। জীবনে যা কিছু ঘটে তা থাকাই ভালো। কেননা গল্প-উপন্যাস তো জীবিতদেরই জগত।

 

সর্বশেষ খবর