শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪ ০০:০০ টা
গল্প

কতিপয় বৃদ্ধের যৌবন

হাসনাত আবদুল হাই

কতিপয় বৃদ্ধের যৌবন

রসুল সাহেবের ফ্ল্যাটেই তাদের আসর বসে, প্রায় প্রতিদিন বিকেলে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত পর্যন্ত। ইসলাম সাহেব আর হাসান সাহেব থাকেন একই বাড়ির অন্য দুটি ফ্ল্যাটে। তারা তিনজন প্রায় একই বয়সী, সবাই পঁচাত্তর বছরের উপরে। তিনজনেরই একটা বা দুটো ক্রনিক অসুখ রয়েছে, যেমন_ ব্লাডপ্রেসার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা এবং প্রস্টেট। রসুল সাহেব ওপেন হার্ট সার্জারি করে বাইপাস করিয়েছেন তিন বছর হলো। ইসলাম সাহেব দুবার প্রস্টেট অপারেশন করিয়েছেন প্রথম অপারেশন সাকসেসফুল হয়নি বলে। হাসান সাহেব মাঝে মাঝেই হাসপাতালে ভর্তি হন অ্যাজমার জন্য শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে।

তিনজনের বন্ধুত্ব পুরনো নয়, নতুন, 'পূর্বাণী' হাই রাইজে আসার পর। একসঙ্গে আসেননি তারা, কয়েক বছরের ব্যবধান ছিল। একই বয়সের হওয়ার জন্য এবং অবসর ভোগী হওয়ার কারণে জানাশোনা হতে সময় নেয়নি তাদের, তারপর ধীরে ধীরে সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে, বন্ধুত্বের পর্যায়ে পেঁৗছেছেন তারা। এখন তাদের সম্পর্কটা এমন যে, রোজ বিকেলে একসঙ্গে দেখা না হলে মনে হয় দিনটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এক সময় সবাই ঘুরে-ফিরে একে অন্যের বাসায় গিয়ে আসর বসাতেন। রসুল সাহেবের স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে আসর তার বাড়িতেই বেশি বসছে। তার বাড়ির কেউ এতে বিরক্ত হয় না, বরং খুশি যে রসুল সাহেবকে বাড়িতে একা থাকতে হচ্ছে না, বন্ধুদের নিয়ে গল্প করে সময় কাটাতে পারছেন। রাজনীতি থেকে নানা বিষয় নিয়ে তারা গল্প করেন। কথার মধ্যে চা-নাস্তা আসে, একবার না, কয়েকবার। চায়ের সঙ্গে দুধ আর চিনি আলাদা আসে। কেননা দুজনের ডায়াবেটিস। কোলেস্টেরলের জন্য তেলে ভাজা নাস্তাও খুব একটা দেওয়া হয় না তাদের। তিনজনেরই সিনেমা দেখার শখ। রসুল সাহেবের ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি ভিডিওর বিশাল কালেকশন। রোজ না হলেও প্রায়ই সিনেমা দেখা হয় তাদের। বেশির ভাগই পুরনো দিনের সিনেমা। দেখার সময় বেশ নস্টালজিক হয়ে যান তারা, পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়।

রসুল সাহেব সেদিন বিকেলে খবরের কাগজটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। তাকে একটু বিমর্ষ দেখাচ্ছে। সকালেও পড়েছেন খবরের কাগজ, পড়ে মাথার কাছে ছোট টেবিলে রেখেছেন। বিকেলে ঘুম থেকে ওঠে সেটা আবার পড়ছেন।

হাসান আর ইসলাম সাহেব প্রায় একসঙ্গেই এলেন, ঘরে ঢুকে রসুল সাহেবকে কাগজ পড়তে দেখে হাসান সাহেব বললেন, শরীরের অবস্থা ভালো নয়, তবে লড়াই করে যাচ্ছেন। তার নাতনি বলেছে, সি ইজ এ ফাইটার।

ইসলাম সাহেব চেয়ারে বসে বললেন, এই নিয়ে বেলভিউ ক্লিনিকে পাঁচবার। চার-চারবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এবারও ফিরবেন। খুব শক্ত মনোবল।

রসুল সাহেব কাগজটা মুড়ে বেড সাইড টেবিলে রেখে বললেন, তাই যেন হয়। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে যান নিজের বাড়ি। আমরা জানব তিনি আছেন, সেই আগের মতো।

ইসলাম সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, অসুখ-বিসুখে মনোবলটাই আসল। মনোবল ভেঙে গেলে শরীর টিকতে পারে না।

হাসান সাহেব বললেন, শুধু কি মনোবল? কি দারুণ সংকল্পবোধ! ডিটারমিনেশন! সেই যে প্রতিজ্ঞা করলেন লোকচক্ষুর বাইরে থাকবেন, থেকেই গেলেন। পঁয়ত্রিশ বছর। পাঁচ বছর, দশ বছর নয়, পঁয়ত্রিশ বছর। কোনো ইন্টারভিউ দিলেন না, ছবি তোলার অনুমতি পেল না কেউ। কাছেই যেতে পারল না বাইরের মানুষ। ভাবা যায়?

ইসলাম সাহেব বললেন, সাধে নাম দিয়েছে প্রাচ্যের গ্রেটা গার্বো। গার্বো ঊনচলি্লশ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। আমাদের মহানায়িকাও পারবেন।

রসুল সাহেব একটা শ্বাস ফেলে বললেন, তাই যেন হয়। তিনি বেঁচে থাকুন, শতায়ু হন। কিংবা তার চেয়েও বেশি।

চা-নাস্তার পর ভিডিও সিনেমা শুরু হলো, গত কয়েক দিন ধরে রোজ যেমন হয়। এক-একটা সিনেমা অনেকবার দেখা তাদের তিনজনের। তাদের প্রজন্মের অনেকেরই দেখা। দেখে দেখে কখনো পুরনো মনে হয় না। ডায়ালগ, দৃশ্য, গান সব মুখস্থ হয়ে গেছে, তবুও একঘেয়ে লাগে না। আর কি আশ্চর্য, আবেগঘন মুহূর্তে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে আসে, শার্টের কোনা তুলে অথবা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে হয় ঘন ঘন। রসুল সাহেবের তো শার্টের উপরের দিকের সবটাই একটু পর ভিজে জবজবে হয়ে যায়।

সিনেমা চলছে, হঠাৎ হাসান সাহেব বললেন, ওই ডায়ালগটা আবার শোনা যাক। দারুণ। কি অপরূপ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলা।

'কার অসুখ?

আমার।

কি হলো হঠাৎ?

আমার যা হয় হঠাৎ করেই হয়।'

শুনে নিয়ে হাসান সাহেব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, কি চমৎকার! অনুরাগের আগে বিরাগের স্পর্শ। সামান্য কথায় ফুটে উঠেছে।

তার কথা শেষ হতে না হতে গানটা শুরু হলো। নায়ক সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমেছে এমন সময় উপর থেকে গানের কথা ভেসে এলো : 'আরে কিছুক্ষণ না হয় রহিতে কাছে। আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে।'

গান শেষ হতেই ইসলাম সাহেব বললেন, আরও একবার শোনা যাক। কি লিরিক! কি সুর! বেঁচে থাকুক গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। বেঁচে থাকুক সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

রসুল সাহেব বললেন, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার বেঁচে নেই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আছেন।

ইসলাম সাহেব বললেন, মহানায়িকার লিপে গানগুলো গাওয়া ইতিহাস হয়ে গেছে। গৌরী প্রসন্ন মজুমদার অমর হয়ে থাকবেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও তাই হবেন।

রসুল সাহেব বললেন, কাউকে ছোট করার জন্য বলছি না। আমার কি মনে হয় জানেন? মহানায়িকার লিপে তার অভিনীত সিনেমায় গাওয়া না হলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এত বিখ্যাত হতেন না। মনে হয় মহানায়িকার লিপের জন্যই তিনি অমন গলা পেয়েছেন।

হাসান সাহেব বললেন, আমরা কথা বলে যাচ্ছি। সিনেমাটা দেখা হোক। আরও কত সিনেমা দেখা বাকি এখনো।

রসুল সাহেব বললেন, সিনেমা দেখে দেখেই আমরা তাকে সুস্থ করে তুলব। কি বলেন?

অন্য দুজন চুপ করে থেকে মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তারপর মনোযোগ দিয়ে সিনেমা দেখতে থাকলেন। একটু পর হাসান সাহেব প্রায় চিৎকার করে বললেন, এই ডায়ালগটা আবার শোনা যাক।

রসুল সাহেব রিমোট দিয়ে রি-ওয়াইন্ড করে ভিডিও আবার চালালেন।

'আপনার এই অভদ্রতা একটা মুখোশ।

মুখোশ না। আত্দরক্ষার কবচ।

কার কাছ থেকে আত্দরক্ষা?

সাধারণত আপনার মতো মেয়েদের কাছ থেকে।

আর অসাধারণত?

আপনার কাছ থেকে।'

দেখেছেন, দেখেছেন। কথা বলার পর নায়কের মুখের অভিব্যক্তি কেমন বদলে গেল। দুজনের ভেতরের কেমিস্ট্রি শুরু। এই না হলে রোমান্স!

সিনেমা শেষ হওয়ার আগে ঘরে ঢুকলো রসুল সাহেবের নাতনি বুলা। তাদের তিনজনকে দেখল একবার তারপর তাকাল টেলিভিশনের দিকে।

রসুল সাহেব বললেন, কি বুলা, কিছু বলবি?

বুলা ইতস্তত করে বলল, এই না মানে তোমরা আর কতক্ষণ দেখবে এই ছবি।

রসুল সাহেব হেসে বললেন, অনেকক্ষণ। এটা শেষ হলে আরেকটা শুরু করব। কেন?

বুলা ভ্রু কুঁচকে বলল, টোয়াইলাইট সাগা শুরু হবে।

রসুল সাহেব হেসে বললেন, ও তোর সেই ফেভারিট ছবি? ভ্যামপায়ার লাভার! কি যে আনন্দ পাস ওই ছবি দেখে। ভ্যামপায়ার লাভার!

তোমরাও যে এই সাদাকালো ছবি দেখে কি আনন্দ পাও তা বুঝিনে দাদু। শুধু ডায়ালগ কোনো অ্যাকশন নেই। বোরিং লাগে না?

রসুল সাহেব হেসে বললেন, মোটেও না। কি যে আনন্দ পাই তা বলে বোঝানো যাবে না। এর জন্য আমাদের বয়সী হতে হবে তোকে।

বুলা গম্ভীর মুখে বলল, তোমাদেরও আমার বয়সী হতে হবে ভ্যামপায়ার লাভার ছবি দেখে আনন্দ পাওয়ার জন্য।

রসুল সাহেব হেসে বললেন, তা বটে। তা বটে। কিন্তু তোর ঘরের টিভিটা কি হলো? সেটায় দেখ গিয়ে।

বুলা বলল, রিসেপশন ভালো আসছে না।

বুলার মা দরজার কাছে এসে বুলার হাত ধরে বলল, এসো আমার ঘরের টিভিতে দেখবে। দাদুদের ডিসটার্ব করো না।

রসুল সাহেব বিব্রত হয়ে বললেন, বৌমা, তাহলে তোমার হিন্দি সিরিয়ালের কি হবে? মিস করবে যে?

বুলার মা হেসে বলল, এক দিন না হয় মিস করলাম। আপনারা দেখুন। তারপর দরজার কাছে গিয়ে বলল, আরেকবার চা-নাস্তা পাঠাব?

রসুল সাহেব বললেন, একটু পর। এই সিনেমাটা শেষ হোক।

পরদিন বিকেলে রসুল সাহেব দেরি করে ঘুমোচ্ছেন। ইসলাম আর হাসান সাহেব ঘরে ঢুকে একটু অপ্রস্তুত হলেন। দুজনে চুপচাপ বসলেন চেয়ারে। তাকিয়ে দেখলেন বেড সাইড টেবিলে সেদিনকার কয়েকটা কাগজ ভাঁজ করে রাখা।

একটু পর রসুল সাহেব চোখ খুললেন। তাদের দুজনকে দেখে প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন।

ইসলাম সাহেব ত্রস্তে বললেন, আহা অমন করে উঠে বসবেন না। হার্টের ওপর প্রেসার হতে পারে। কোনো টেনশন করবেন না। দেরি করে ঘুমোচ্ছেন, তাতে কি হয়েছে? বিশ্রামটাই বড় কথা।

রসুল সাহেব বিছানার পাশে পা ঝুলিয়ে স্যান্ডেল পরে নিতে নিতে বললেন, আজ একটু বেশিই ঘুমালাম। মনে হয় ক্লান্ত ছিলাম।

হাসান সাহেব হেসে বললেন, ঘুমোবেন। আমাদের এখনকার কাজই তো খাওয়া আর ঘুমোনো।

ইসলাম সাহেব হেসে বললেন, আর ভিডিওতে সিনেমা দেখে অতীতে ফিরে যাওয়া। ডাউন মেমোরি লেন। রসুল সাহেব বেড সাইড টেবিলে সাজিয়ে রাখা কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকের খবর খুব ভালো নয়। পড়েছেন নিশ্চয়?

হাসান সাহেব বললেন হ্যাঁ। ওই খবরই তো প্রথমে পড়ি। বেশ দুরু দুরু বুক নিয়েই পড়ি। টেলিভিশনের স্ক্রলের দিকেও তাকাই ভয়ে ভয়ে।

রসুল সাহেব বললেন, গতকাল থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। প্রায় সারা দিনই তিনি ঘুমোতে পারছেন না। শুধু ইশারায় সাড়া দিচ্ছেন। শরীর খুবই দুর্বল। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার ফুসফুসে পানি জমেছে অ্যান্ডোট্রাকিয়াল টিউবের মাধ্যমে কফ বার করা হয়েছে। সাকশন মেশিনও ব্যবহার করা হয়েছে। এ সময় কফের সঙ্গে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। কষ্ট হওয়ায় বার বার মুখের নল খুলে ফেলার চেষ্টা করেছেন তিনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে রাখার পর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে।

একটা খবরের কাগজের খবর পড়া শেষ করে আরেকটা কাগজ তুলে নিলেন রসুল সাহেব।

ইসলাম আর হাসান সাহেব দুজনের মুখই গম্ভীর। তারা মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হাসান সাহেব চোখ তুলে রসুল সাহেবকে দেখে বললেন, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এমন তার আগেও হয়েছে। তিনি ভালো হয়ে উঠেছেন। এবারও হবেন। শেষের কথাটা তিনি জোর দিয়েই বললেন।

অন্যান্য দিনের মতো আজও চা-নাস্তা এলো। তিনজন চুপচাপ চা খেলেন, অন্যমনস্কের মতো বসে থাকলেন যার যার চেয়ারে। কেউ কথা বলছেন না। এক সময় রসুল সাহেব নড়েচড়ে বসলেন, গলা পরিষ্কার করে বললেন, এভাবে থাকলে তো চলবে না। তিনি আমাদের মধ্যে আছেন, থাকবেন। আমরাই তো এই ঘরে বসে বলেছি তিনি আগের মতো আবার সুস্থ হয়ে ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরে যাবেন। আসুন, সিনেমা দেখা যাক। সিনেমা দেখেই তার রোগ মুক্তি কামনা করব আমরা।

ইসলাম সাহেব খুশি হয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন। এভাবে মুখ ভার করে থাকার মানে হয় না। সিনেমা দেখা যাক। পুরনো সেসব ডায়ালগ আর গান ফিরিয়ে নিয়ে যাক আমাদের পেছনের দিনগুলোতে।

হাসান সাহেব বললেন, কাগজের খবর পড়ে আমরা আমাদের কথা ভুলে গেছি।

আমাদের কথা? ইসলাম সাহেব তাকালেন তার দিকে।

হ্যাঁ। আমাদের কথা। তাকে ছবিতে দেখা মানে কি আমাদের কথাই বলা নয়? আজকের আমরা নই, অনেক দিন আগের আমরা। আমাদের জীবনের সোনালি সময়। তার মতো আর কে পেরেছে এভাবে পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে?

রসুল সাহেব উঠে ডিভিডি চালু করতে করতে বললেন, হ্যাঁ। 'আমাদের' বলে একটা সময় ছিল। সে সময় তিনি যেমন করে ফিরিয়ে নিয়ে যান আর কেউ তেমন পারে না।

'আচ্ছা আপনি কি সেই তাপসী দেবী যিনি খুব ভালো গান করেন?

আপনি কোথায় শুনলেন?

যদি ধন্যবাদের পাত্র মনে করেন তাহলে একটা গান শুনিয়ে দিন না।

আপনি বোধহয় খুব বেশি মানুষের সঙ্গে মেশেন না, না?

কেমন করে জানলেন?

সাধারণ লোক এত অল্প আলাপে কোনো অপরিচিত মেয়েকে গান করতে বলে না। অথচ আপনি বলে ফেললেন।'

মুখস্থের মতো কথাগুলো বলে গেলেন ইসলাম সাহেব। কথা শেষ করে হেসে দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক বলেছি তো? ভুল হয়নি কোনো?

না। তেমন মনে হলো না। হাসান সাহেব হেসে বললেন।

ইসলাম সাহেব বললেন, কেমন করে ভুল হবে? কতবার আউড়েছি, সেই প্রথম দেখার পর থেকে। কি দারুণ রোমান্টিক দৃশ্য। চারদিকে কুয়াশা। পাহাড়ের চূড়া এখানে সেখানে মাথা উঁচিয়ে আছে। চারিদিক অস্পষ্ট। তার মধ্যে দুজন বসে আছে পাহাড়ের পাশে পাথরের উপর। সেই প্রথম দেখা। আর তারপরই সেই গান। বুক মোচড়ানো, মন কেড়ে নেওয়া কথা, অবশ করা সুর। গানে মোর কোনো ইন্দ্রধনু।

রসুল সাহেব বললেন, সে সময় গানটা লোকের মুখে মুখে চলত। যারা গাইতে পারত না তারাও গাইত। আমিও বাদ যাইনি বলে তিনি হাসলেন। তার পর অভিভূতের মতো বললেন, সে এক সময় ছিল বটে।

ইসলাম সাহেব বললেন, সিনেমাটা আমি অন্তত পঁচিশবার দেখেছি।

হাসান সাহেব বললেন, কম করে হলেও আমি বিশবার।

রসুল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি কতবার দেখেছি মনে নেই। তবে অনেকবার। যখন পয়সা ছিল না টেঙ্ট বই বিক্রি করে সিনেমায় গিয়েছি। একটা নেশা ছিল বটে।

হাসান সাহেব বললেন, তার রেশ এখনো রয়ে গেছে।

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা, তার পর রাত শুরু হয়েছে। তিনজন ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে আছেন। খবরের কাগজগুলোও বিছানার উপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। চায়ের কাপে চা অর্ধেক খাওয়া ঘরের ভেতর থেকে থেকে ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঢুকছে। তিনজনের শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে তার স্পর্শে।

রসুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এভাবে চুপ করে থাকার মানে হয় না। এতে দুঃখ আরও বাড়ে। কিন্তু দুঃখ পেলে তো চলবে না।

হাসান আর ইসলাম সাহেব তার দিকে তাকালেন। রসুল সাহেব বললেন, যিনি এত আনন্দ দিয়েছেন আমাদের, রোমান্স জাগিয়েছেন মনে তার কথা ভেবে দুঃখ পেলে চলবে কেন? দুঃখের ভেতর থেকে আনন্দ খুঁজে নিতে হবে।

হাসান সাহেব নড়েচড়ে বসে বললেন, তাহলে সিনেমা শুরু হোক। আমরা আনন্দের জগতে ফিরে যাই। তিনি তো সেই জগতেরই মানুষ।

সিনেমা শেষ হলে রসুল সাহেব বললেন, সেই লোকটার কথা নিশ্চয়ই পড়েছেন কাগজে?

কার কথা? হাসান সাহেব তাকালেন তার দিকে।

রসুল সাহেব বললেন, ওই যে জয়পুর থেকে চলে এসেছিল কলকাতায়। বেলভিউ ক্লিনিকে ঢুকে কেবিনের দরজা পর্যন্ত পেঁৗছে গিয়েছিল। ভেতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় সিকিউরিটি এসে ধরে ফেলল। ভদ্রলোক জানালেন তিনি তিরিশ বছর আগে দেখেছিলেন তাকে। শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিলেন।

ইসলাম সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, খুব সাধারণ মানুষ মনে হচ্ছে। কোনো কল্পনা শক্তি নেই।

 

সর্বশেষ খবর