সেবার কলেজের বার্ষিক প্রতিযোগিতা। পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। নতুন কলেজ, আমিও পাস করে প্রথম চাকরি পেয়ে ঢুকেছি। অধ্যক্ষ আমাকে ডেকে বললেন, ‘পুরো পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানের সামগ্রিক দায়িত্ব আপনাকে দিলাম। এই অনুষ্ঠানের সাফল্যের ওপর আগামী বছর বেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়া নির্ভর করছে জানবেন।’
মফস্বল কলেজ। কাছাকাছি আরও দুটি কলেজ রয়েছে। কাজেই অনুষ্ঠান জাঁকজমকপূর্ণ হওয়া চাই। ১৯৬৮-৬৯ সালে সারা দেশে অনেক নতুন কলেজ গজিয়ে উঠেছিল। তার মধ্যে আমাদের কলেজও একটি। পাঠাগার, বিজ্ঞান গবেষণাগার, মিলনায়তন— সবখানে টাকার অভাব। হাজী নেয়ামত আলী ভ্রাতৃদ্বয় জমি কিনে দোতলা একখানা অট্টালিকা তৈরি করে নিজেদের নাম বসিয়ে দিয়েছে কলেজে। আর ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের বছর সদ্য পাস করে আমিও চাকরি পেয়ে ঢুকে পড়লাম।
সে বছর মার্চ পড়তেই গরম শুরু হয়ে গেল বসন্তের বদলে। প্রতিযোগিতা চলাকালে সেই অস্বাভাবিক গরমে প্রতিদিন দু-একজন ছাত্রছাত্রী মূর্ছা যায় ক্লাস চলাকালে। তাতেও ছাত্রছাত্রী বা আমার উত্সাহে ঘাটতি নেই একটুও। অনুষ্ঠানে জনসমাগমও প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। ১৯৭৩ সাল। সবার মনে নতুন উদ্দীপনা। আমিও লেগে গেছি কলেজ গড়ার কাজে। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিতর্ক, আবৃত্তি, সাহিত্য সভা, খেলাধুলা করে মাতিয়ে তুলেছি কলেজ।প্রতিযোগিতা শুরুর দিন ‘যেমন খুশি সাজো’ রেখেছি। নাটক আছে একদিন- মুনীর চৌধুরী, যিনি আমার শিক্ষক ছিলেন তার কবর। ছায়া নৃত্যে মুক্তিযুদ্ধের টুকরো কাহিনী। এছাড়া বক্তৃতা, আবৃত্তি, মূকাভিনয় ইত্যাদিতেও কারও তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছেমতো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করেছি। অধ্যক্ষ ভিতরে ভিতরে কিছু ভেবে থাকলেও কিছু বলতে পারছেন না।
আগের দিন অনেক রাত জেগে কাজ করলেও সকাল-সকাল ঘুম থেকে ওঠে পড়লাম। দরজা খুলে মাঠের দিকে তাকাতেই দেখি মানুষের একটি মূর্তি অতিথিদের মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চমত্কার ভঙ্গি করে। কৌতূহলী হয়ে ছুটে গেলাম। তখনো কেউ মাঠে এসে পৌঁছোয়নি। সবে ভোর হয়েছে। মণ্ডপের সামনে শামিয়ানার বাইরে দুই হাত উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটি। ৮টায় প্রতিযোগিতা শুরু হবে। উদ্বোধন করবেন জাতীয় সংসদের একজন মহিলা সদস্য, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৯ নম্বর সেক্টরে তার সঙ্গে পরিচয়। ক্যাম্পে সবার সঙ্গে তিনি সানকিতে ভাত খেতেন, কঠিন শৃঙ্খলা মেনে নিয়ে তিনি সবার সঙ্গে ঢালাও শয্যায় শুইতেন, পালা অনুযায়ী রাত জেগে ছাউনি পাহারা দিতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক সচেতন করার ক্লাস নেওয়া ছিল তার অন্যতম দায়িত্ব।
মূর্তির কাছে গিয়ে আমি হতভম্ব, স্তব্ধ। তার গায়ে মুক্তিযোদ্ধার পোশাক। শরীরের মাপজোখ সবই ঠিক। কিন্তু ভাস্কর্যের মতো অনড় দাঁড়িয়ে আছে, এমনকি চোখের পাতা পর্যন্ত পড়ছে না। মুখে ও হাতে যে অংশ পোশাকের বাইরে আছে তা ইস্পাতের মতো চকচক করছে। সৈনিকের কঠোরতা মুখে, এক হাতে গ্রেনেড আর কাঁধে ঝোলানো রাইফেল ধরে আছে অন্য হাতে। ছেলেটি কলেজের ছাত্র নয় কিনা চিনতে পারলাম না। ‘যেমন খুশি সাজো’তে বাইরের অর্থাৎ স্কুলের যে কেউ অংশ নিতে পারে এ রকম একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। কারণ তারাই তো কলেজের ভবিষ্যৎ ছাত্র। এছাড়াও স্কুলের ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করতে পারে তেমন সুযোগ আরও দু-একটিতে রেখেছি। ছেলেটির মুখ এমন ইস্পাত চকচক করেছে যে, চেনা মুশকিল।
আলাপ শুরু করার অনেক চেষ্টা করেও ফল হলো না। মনোবিজ্ঞানসম্মত প্রশ্ন করেও ফল পেলাম না। কোনো কথাই বলে না, নড়ে-চড়েও না। একবার সন্দেহ হলো আসলেই ভাস্কর্য কিনা। ততক্ষণে কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে, আমার সহকর্মীরা ঘুম থেকে ওঠে ছুটে এসেছে। মূর্তির ডান হাতের গ্রেনেড জীবন্ত তাজা কিনা কে জানে! যেমন খুশি সাজোতে এরকম জীবন্ত একটা ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে যেতে পারে আমার কল্পনার বাইরে ছিল। কারণ ওকে দেখে অনেক কিছু ভেবে আবার গুটিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। কেন তা পরে বুঝতে পারবেন। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল এভাবে রাইফেল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আইনের চোখে অপরাধ কিনা, অথবা সৈনিকের পোশাক সে কোথা থেকে জোগাড় করল, থানা থেকে এসে তাকে যদি অবৈধ অস্ত্রের জন্য গ্রেফতার করে, কিংবা জাতীয় সংসদ সদস্যের নিরাপত্তার জন্য বৈধ অস্ত্র হলেও পুলিশ যদি ধরে...। এ রকম নানা চিন্তা আমাকে বৈধ-অবৈধ দু’ভাবে অধিকার করে নিল।
দেখতে দেখতে লোকজনের ভিড় জমে গেল! সবাই মূর্তিটাকে একনজর দেখতে চায়, অনেকে মূর্তির চারদিকে ভিড় করে দাঁড়িয়েই রইল। শেষে মূর্তির পরিচয় জানতে পেলাম। উদ্বোধনের সময় সংসদ সদস্য নিজে মূর্তিটিকে হাতে ধরে মঞ্চে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মূর্তি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলা শুরু করল।
‘—এই যে কলেজের পশ্চিমে মাঠ, মাঠের পাশে কলেজের সড়ক... আগে এই রাস্তার নাম ছিল আরাকান সড়ক। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কোপ থেকে বাঁচার জন্য তার ভাই শাহ সুজা এ রাস্তা নির্মাণ করতে করতে আরাকানে পালিয়ে যান। তাই এর নাম আরাকান সড়ক। ...ইংরেজ আমলে এ এলাকা সূর্যসেনের বিপ্লবের কেন্দ্রভূমি ছিল। তারও বহু বছর পর... বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কম্যুনিস্ট নেতা পূর্ণেন্দু দস্তিদার যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান তখন আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব বলে বেরিয়ে তার সঙ্গে দেখা। তিনি তো মারা গেলেন, আমি চলে গেলাম প্রশিক্ষণ নিতে। প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এলাম নিজের গ্রামে। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। অস্ত্র হাতে নিলে বুকের ভিতর জেগে ওঠে সাহসের প্রচণ্ড পাহাড়, তখন শত্রু দেখে আর ভয়ে কেঁপে উঠি না। একদিন আরাকান সড়কের পাশে অ্যাম্বুশ পেতে বসে আছি শত্রুর অপেক্ষায়। দলে ছিলাম ১৫ জন। শত্রুর দুটি কনভয় বিকল করে দিয়েছি, পঁচিশ থেকে ত্রিশজন শত্রু খতম, বাকি সামরিক দুটো ট্রাকও অচল করে দিয়েছি। অপারেশন শেষ ভেবে আমরা দ্রুত পালিয়ে গেলাম। কারণ তখনই খবর পেলাম পেছনে আরেকটি দল তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে। ফেরার পথে এই কলেজের সামনে আমরা ধরা পড়ি। তখন আমাদের হাতে অস্ত্র ছিল না। দিনের বেলা, হাতে অস্ত্র নিয়ে ফেরা বিপজ্জনক বুঝে আমরা পাঁচজন হাসি-খুশি গ্রামের মানুষের মতো কথা বলতে বলতে রাস্তা অতিক্রম করছি। দলের আর কেউ বুঝতে না পারলেও আমি বুঝতে পারলাম কার ইঙ্গিতে আমরা ধরা পড়লাম। দুপুরে ধরা পড়েছি আর সন্ধ্যা হতে না হতেই আমাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করল। ওই যে দুই মাইল দূরে মুড়া দেখছেন, তারই কাছাকাছি নির্জন মাঠের মাঝে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করল। আর একটু গেলেই মুড়া, সেখানে আমাদের একচ্ছত্র রাজত্ব। কিন্তু আমাদের দলের সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ঠিক সময়ে কেউ খোঁজ নিতে পারেনি আমরা কে কোথায় ছিলাম।...
‘গুলি লেগেছিল বুকের কাছেই। পিঠ দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেলেও আমি মরিনি। আমি যে মরিনি সে বোধ হলো করবে গিয়ে, যেখানে আমাদের গুলি করে হত্যা করে সেখানেই বড় একটা গর্ত করে একসঙ্গে পাঁচজনকে মাটিচাপা দেয়, ধর্মীয় কোনোরকম রীতিনীতি ছাড়া। কবরে শুয়ে শুয়ে টের পেলাম তখনো মরিনি। নিঃশ্বাস ফেলার সময় পিঠের দিকে ভক ভক করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে নাকি হাওয়ার কোনো কারসাজি কিছুই বুঝতে পারছি না। কবরের মাটি ঠেলে বেরিয়ে আসার শক্তিও নেই। কতক্ষণ কবরে শুয়ে আছি কি মৃত সে বোধ আসতে অনেক সময় কেটে যায়। একবার মনে হলো মৃত্যুর পরবর্তী জীবন শুরু হয়ে গেল বুঝি। চারদিকে কবরের অন্ধকার। গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে সঙ্গীর লাশের স্পর্শ, নিজের শরীরের সামান্য উত্তাপে অনুভব করতে পারি অন্যদের ঠাণ্ডা ও শক্ত দেহ। পিঠের দিকে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ বা অনুভূতি আঁচ করতে পারি, ক্রমশ মনে হয় নিঃশ্বাসের সঙ্গে কফ-থুতু বেরিয়ে যাচ্ছে পিটের ছিদ্র দিয়ে। হাত দুটি শরীরের সঙ্গে সোজা লম্বালম্বি পড়ে আছে, ঘুরিয়ে আনতে পারছি না। তারপর অনুভব করতে পারলাম প্রবল তেষ্টা, তৃষ্ণার দাপটে খিদে চাপা পড়ে আছে। বুঝতে পারি কবরে গাদাগাদি শুয়ে আছি অথবা একগাদা মৃতের সঙ্গে কোনো অন্ধকার বদ্ধঘরে। একবার মনে হলো হাসপাতালের মর্গে, কারণ মর্গে গাদাগাদি মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্য আমার মনে আছে।...
‘এক সময় কবরে শুয়ে শুয়ে কিছু ফিসফিস শব্দ শুনতে পাই। একবার মনে হলো আমার সঙ্গে শুয়ে থাকা মানুষগুলোই বুঝি কথা বলছে। দুজন তিনজন একসঙ্গে কবরে দেওয়াই তো ভালো হয় দেখছি! টিপু, মোস্তফা, বিল্লাল ও খোকন নয়তো সঙ্গে! ওরাও আমার সঙ্গে সারবন্দী দাঁড়িয়েছিল। কে যে গুলি করেছিল বুঝতেই পারিনি। সবার মুখ বাঁধা ছিল। তবে অনুমান আমি ঠিকই করেছিলাম। যাক সে কথা। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের কথাও ভাবলাম একবার, তাহলে পরলোকের কোনো জীবন বুঝি ফিরে পেয়েছি, অথবা অন্য জীবন পেয়ে কোথাও জন্ম নিয়েছি কিনা, অথবা মৃত্যুর পর আগের জীবনের কথা মনে পড়ছে বুঝি! ভাবতে ভাবতে শুনতে পাই মাটি খোঁড়ার শব্দ। কোদাল চালিয়ে যাচ্ছে একজন হয়তো, অথবা শিয়ালের থাবা দিয়ে মাটি খোঁড়ার শব্দ হয়তোবা।...
‘ভোর রাতেই বন্ধুরা কবর থেকে তুলে চিকিত্সা করে আমার। টিপু, মোস্তফা, বিল্লাল ও খোকন শহীদ হয়। আস্তে আস্তে আমার বুক ও পিঠে ছিদ্র-দুটি বন্ধ হয়, ঘা শুকোয়, হাঁটাচলা করতে আর কষ্ট হয় না, কথা বলতে পারি স্বাভাবিকভাবে, গাইতে পারি আগের মতো, ভালোবাসার অনুভূতিও ফিরে পাই। বাবার সঙ্গে দেখা করি এক রাতে চুপি চুপি। তারপর দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমি ঢাকার হাসপাতালে। আমি স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠছি দিন দিন। কিন্তু মৃত মানুষের মতো অনড় এবং অপলক চোখে তাকিয়ে থাকার আশ্চর্য শক্তি আমার আয়ত্তে চলে আসে। কারও সঙ্গে কথা না বলে হাত-পা বা কাঁধের ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো মুদ্রাদোষ কাটিয়ে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। একাধিক্রমে দুই বছর হাসপাতালে ছিলাম। দেশের বড় বড় সব হাসপাতালে রোগী হিসেবে থেকে এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। সেই সঙ্গে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকার দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আমি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা বা অপলক তাকিয়ে থাকা আমার স্বাভাবিক রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাত্র গতকাল আমি গ্রামে ফিরেছি এবং ঘরে ফিরে শুনতে পাই কলেজের অনুষ্ঠানের কথা।...’
লোকজনের ভিড়ের মাঝে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে অর্থাৎ দুনিচাঁদ কাউকে নিজের পরিচয় দেয়নি, একবারও মুখ খোলেনি। শুধু তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে ফিসফিস করে বলে দেয় পরিচয়। অধ্যক্ষ এসে আমার কাছে তার উষ্মা প্রকাশ করে গেছেন কয়েকবার। তবুও মাইকের সামনে দুনিচাঁদ যখন নিজের কথা বলতে শুরু করে অনুষ্ঠানের সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকে। তার আশ্চর্য ব্যাধি সবার কাছে যেন খেলা মনে হতে থাকে। সবাই চিত্কার করে ওঠে, শুনতে চাই, শুনতে চাই। তখন সে আবার বলতে থাকে...
‘আমি কবরে শুয়ে শুয়ে অন্য জীবনের কথা বহুবার ভেবেছি। মৃত্যুর পর মানুষের যে জীবন, সেই জীবনে তাহলে মানবজীবনের কথা মনে থাকে? মনুষ্য জীবনে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছি, গ্রেনেড ছোড়ার সময় সেপটিপিন দাঁত দিয়ে খুলেছি প্রায় অবহেলা ভরে। যুদ্ধের সময় শত্রু কে পরিষ্কার ছিল, রাজাকার-আলবদর বা পাকিস্তানিদের গায়ের চামড়া দেখেই চিনতে পারতাম, রাইফেলের নিশানা ঠিক করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে দেখতে পেতাম এক একজন শত্রু কীভাবে ফৌত হচ্ছে। আর কবর থেকে ফিরে এসে আমি কবরের বাসিন্দার মতো একনাগাড়ে স্থির অনড় থাকার কৌশল রপ্ত করে নিয়েছি— তাদের সঙ্গে আমার তফাৎ এটুকু যে, আমি চোখ খুলে দেখতে পাই, কবরের বাসিন্দারা কিছুই দেখতে পায় না বা অনুভব করতে পারে না। তবে সত্যি করে আমি বলতে পারি না তারা দেখতে পায় কি পায় না।...’
যেমন খুশি সাজোতে দুনিচাঁদ প্রথম পুরস্কার পাবে আমার কোনো সন্দেহ নেই। পুরস্কার বিতরণ হবে শেষ দিন। তবে সত্যি কি দুনিচাঁদ প্রথম হবে, নাকি আলতাপারি পাখির খাঁচা ছেড়ে সোনালি-হলুদ-ধূসর ডানার হোলিখেলা দেখিয়ে আবার খাঁচায় ফিরিয়ে আনা সেই পাখিওয়ালা ছেলেটি পাবে কে জানে! সংসদ সদস্য তার বক্তৃতায় কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গে কিছুই না বলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বলে গেলেন। দুনিচাঁদ সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের মোড় ঘুরিয়ে দিল। এক ঘণ্টা ধরে আমরা দুনিচাঁদ ও সংসদ সদস্যের কথাই শুনে গেলাম। আমরা সবাই তাদের কথা নিঃশ্বাস না ফেলে শুনলাম। জনসাধারণের মধ্যে কেউ কেউ, বিশেষ করে কলেজ পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন। ছাত্রছাত্রী সংসদের সবাই দুনিচাঁদকে নিয়ে কোথায় চলে গেল কে জানে!
সন্ধে নেমে এলো। অধ্যক্ষ হয়তো মাথা নিচু করে বসে আছেন তার চেয়ারে। অনেক দিন পর আমি যুদ্ধে সেই ভয়াবহ ও আনন্দময় দিনগুলোর পাশাপাশি দুনিচাঁদের এ কাহিনীকে রেখে ভাবতে বসেছি। অধ্যক্ষের মনেও হয়তো দুনিচাঁদের কাহিনী ঘোরাফেরা করছে। লোকজন চলে গেছে। আমার সহকর্মীরাও যে যার বাসায় চলে গেছে। কলেজের দারোয়ান বুড়ো দয়াল হরি তার ভাত রাঁধতে চলে গেছে নিজের ঘরে, রাস্তা দিয়ে দু-একটা গাড়ি চলাচলের শব্দ ভেসে আসছে থেকে থেকে, রাস্তার বাঁক ঘুরতেই গাড়ির হেডলাইটের আলো কলেজ ভবনকে ক্ষণিকের জন্য ঝলমল করে আবার অন্ধকারে ফেলে যে যার কাজ সমাধায় ব্যস্ত। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রথম দিনের অনুষ্ঠানটি একদিক থেকে সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছে বলা যায়। আর দুনিচাঁদের ঘটনাকে কেউ যদি বাঁকা চোখে দেখে তাহলে অনুষ্ঠান একেবারে পণ্ড হয়ে গেছে বলা যায় হয়তো...।
সন্ধে পেরিয়ে আরও রাত হলো। কলেজের অধ্যক্ষ কী ভাবছেন জানার জন্য আমি আস্তে আস্তে তার কক্ষের দিকে যাচ্ছি, আর তখনই সেদিক থেকে ভেসে এলো পিস্তলের ধাতব শব্দ। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং থেকে আজ পর্যন্ত যেখানে যত গুলির শব্দ শুনেছি সঙ্গে সঙ্গে আঁচ করে নিতে পেরেছি কোন শব্দ কোন অস্ত্রের।
আমি দ্রুত পা চালিয়ে ছুটে গেলাম অধ্যক্ষের কক্ষের দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখি কোথাও কেউ নেই, শুধু অধ্যক্ষের মৃতদেহ চেয়ারে কাত হয়ে ঢলে পড়ে আছে।