শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পরবর্তীকাল

ইমদাদুল হক মিলন

পরবর্তীকাল

ছেলেটি রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল। তখন দুপুরবেলার তীব্র রোদ ছড়িয়ে ছিল শহরের আনাচে কানাচে। ভ্যাপসা গরমে কাঁঠাল পেকে ফেটে গেলে, কাঁঠালের ভেতর থেকে যে রকম চোখ ধাঁধান হলদে একটা আভা বেরয়, রোদের রঙ ছিল সেরকম। দুটো বেজে গেছে কয়েক মিনিট আগে। এই সময় রিকশা পাওয়া মুশকিল। দুটো বাজে রিকশাঅলাদের বদলির সময়। দুটো বাজার খানিক আগে থেকেই রিকশাঅলাদের মধ্যে সময় মতো মালিকের চোখের সামনে গিয়ে পৌঁছানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। তখন নিজের এলাকামুখী সওয়ারি না পেলে রিকশায় তোলে না তারা।

দুটো বাজার খানিক পরই ভাতপানি খেয়ে, পান চিবাতে চিবাতে কিংবা বিড়ি সিগ্রেট ফুঁকতে ফুঁকতে তরতাজা রিকশাঅলারা বেরুবে। আয়েশি ভঙ্গিতে রিকশায় প্যাডেল মারতে মারতে সওয়ারি খুঁজবে। ছেলেটি সেই মুহূর্তের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গরমে ঘামছিল ছেলেটি। আর উদগ্রীব হয়ে একবার হাতঘড়ির দিকে, একবার সামনের বড় রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল। খালি রিকশা আসে, খালি রিকশা যায়। খালি রিকশা দেখলেই ছেলেটি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, যাবে নাকি?

কেউ রাজি হয় না।

আসলে যে সব রিকশার উদ্দেশে সে জিজ্ঞেস করছিল, তাদের প্রত্যেকেরই তখন বদলির সময়।

এই জেনারেশানের ছেলেমেয়েরা কেউ রিকশার ভাড়া ঠিক করে না। খালি পেলেই লাফিয়ে ওঠে। অমুক জায়গায় যাও, তমুক জায়গায় যাও।

কিন্তু ছেলেটির ভাগ্য খারাপ। তার গন্তব্যের দিকে যেতেই রাজি হচ্ছে না কোনও রিকশাঅলা। দুয়েকটায় লাফিয়ে চড়তে গিয়ে সে ব্যর্থ হয়েছে। রিকশাঅলা হাঁ হাঁ করে জিজ্ঞেস করেছে, কই যাইবেন ছাব?

বাধ্য হয়ে তাকে জায়গার নাম বলতে হয়েছে।

তারপর প্রত্যাখ্যান। ভেতরে ভেতরে খুব রেগে যাচ্ছিল সে। হয়তো একটা সুন্দর জায়গায় যাচ্ছে সে। মেজাজ খারাপ করে সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না। নয়তো যে কোনও একটা রিকশায় চড়ে বসে থাকত। রিকশাঅলা হাজার অজুহাত দেখালেও নামত না। জায়গা মতো রিকশাটাকে নিয়ে ছাড়ত। বেশি বাড়াবাড়ি করলে রিকশাঅলার নাকমুখ ফেটে যেত। কেউ ঠেকাতে পারত না। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরকম কিছু করতে চায় না সে। মেজাজ খারাপ নিয়ে প্রিয় সেই জায়গায় যেতে চায় না। সুতরাং ছেলেটির মন খারাপ হয়ে যায়। বার বার হাতঘড়ি দেখে। তার খুবই জরুরি দরকার। হয়তো বা ম্যাটিনি শোতে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে সে। সিনেমা হলে হয়তো বা তার অপেক্ষায় আছে প্রেমিকা কিংবা প্রিয়তম বন্ধুরা। কিংবা সে হয়তো গোপন কোনও জায়গায় মিলিত হতে যাচ্ছে প্রিয়তমা কোনও যুবতীর সঙ্গে। সময় দেয়া আছে। সেই মূল্যবান সময়, হায় বয়ে যায়, বয়ে যায়। ছেলেটি রিকশা পায় না। তার প্রিয়দর্শন মুখে একসঙ্গে খেলা করে অসহায়ত্ব, বিরক্ত এবং বিষণ্নতা। ছেলেটি মন খারাপ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। খালি রিকশা ছাড়া অন্য কোনও দিকে তার মনোযোগ নেই।

তবে ছেলেটির দিকে মনোযোগ ছিল পথচারীদের।

তখন অফিস ছুটির সময়। ছেলেটি যে এলাকায় দাঁড়িয়ে ছিল তার চারপাশে ম্যালা অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ছুটির সময় বলে রাস্তায় মিছিলের মতো লোক চলাচল ছিল। বেশির ভাগই অফিস ফেরত ক্লান্ত মানুষের দল। তারা সবাই একপলক হলেও ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখছিল।

ছেলেটি ওসব একদম খেয়াল করে না। কোথাও কেউ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। কে? প্রেমিকা! ছেলেটি তার কাছে যাবে। ছেলেটি তার প্রিয়তম মানুষের কাছে যাবে।

ছেলেটি দেখতে চমৎকার। একুশ বছর বয়স। এই ডিসেম্বরে বাইশে পড়বে। লম্বায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম। স্বাস্থ্য বেশ ভালো। ক্লিন সেভড। গায়ে নীল রঙের হাতাকাটা। টিশার্টের বুকে মাইক্রোফোন হাতে উন্মত্ত ভঙ্গিতে পোজ দিয়ে আছে বর্তমান পৃথিবীর সবচাইতে খ্যাতিমান যুবক গায়ক মাইকেল জ্যাকসান। ইংরেজি বাঁকা হরফে, সাদা রঙে মাইকেল জ্যাকসান নামটা লেখা আছে। ছেলেটির মাথার চুল নিগ্রোদের মতো কার্ল করা। বাগজো কোম্পানির ছাই রঙের প্যান্ট পরা সে। কোমরে একই কোম্পানির সাদা বেল্ট। বাঁধার পরেও নাভির নিচে বিঘত খানেক ঝুলে আছে বেল্টটা। এটাই এখনকার ফ্যাশান।

ছেলেটির পায়ে ছিল অলিম্পিক লেখা ঘি রঙের কেডস। একহাতে কালো বেল্টের ছোট্ট ঘড়ি। অন্যহাতে তামার পাতের বালা। হাত কামড়ে লেগে আছে বালাটা। হাতটা বেশ লোমশ।

বাড়ি থেকে বেরুবার আগে শরীরে খুব করে ব্রুট সেন্ট স্প্রে করেছে সে। দুপুরের তিরতিরে হাওয়ায় ছড়িয়ে ছিল ব্রুটের মৃদু অথচ পুরুষালী সুবাস।

একসময়, একটা পা নেই, ক্রাচে ভর দেয়া এক মানুষ ক্রাচে ঠুক ঠুক শব্দ তুলে রাস্তার মোড় পেরিয়ে ছেলেটির দিকে এগিয়ে আসেন। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়স হবে তাঁর। ভাঙাচোরা শরীর। চেহারায় কঠিন পরিশ্রমের ছাপ। দাড়ি গোঁফে একাকার মুখটা শুকনো। কোটরে বসা চোখ দুটো ফ্যাকাশে। মাথায় মাকরসার জালের মতো উসকো খুসকো চুল। কতকাল তেল সাবান পড়ে না চুলে কে জানে! পরনে জীর্ণ, ধূলিমলিন খদ্দরের পাজামা পানজাবি। একটা পা নেই বলে পাজামার সেই অংশটা হাঁটা চলার তালে তালে টলমল করে নড়ছে।

একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে টাইপিস্টের কাজ করেন তিনি। দশটা পাঁচটা অফিস তাঁর। সরকারি প্রতিষ্ঠান নয় বলে তাঁর কাজটা দীর্ঘক্ষণের। মাঝখানে দুপুর একটা থেকে দুটো অব্দি বিরতি। তখনও অফিস থেকে বেরন না। ছোট্ট টিফিন বক্সে করে আনা শুকনো দুখানা রুটি আর মুখে লাগে না এমন একটু ভাজিভুজি কিংবা আগের রাতের খাদ্য থেকে বাঁচিয়ে রাখা তরকারি দিয়ে দুপুরের খাবারটা অফিসে নিজের টেবিলে বসেই সারেন। তারপর একটা স্টার সিগ্রেট ধরিয়ে আনমনা হয়ে থাকেন। ওই সময় নিজের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তাঁর। সুখের দিন, দুঃখের দিন এবং ভয়াবহ এক যুদ্ধের স্মৃতি তাঁকে পুরো লাঞ্চ আওয়ারটা আনমনা করে রাখে।

আজ লাঞ্চ আওয়ারে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। বাসায় তাঁর বৃদ্ধা মা অসুস্থ। মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন তিনটের সময়, সময় দিয়েছেন ডাক্তার। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় যাওয়া দরকার তাঁর। ক্রাচ ঠুকে ঠুকে যতদূরে সম্ভব দ্রুত পায়ে চলছিলেন তিনি। রিকশায় চড়ার মতো আয়েশ তিনি কখনও করতে পারেন না। তাঁর যা মাসিক আয় তাতে তিনটি ভাইবোন, বৃদ্ধা মা এবং বাসা ভাড়া ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে একটি পয়সাও বাড়তি খরচের কথা ভাবতে পারেন না তিনি। ভাইবোন তিনটি আবার স্কুল কলেজে পড়ে। এই চাকরির আয়ে সংসারটা তিনি চালাতেই পারতেন না, যদি তাঁর কলেজে পড়া ভাইটি দুতিনটে টিউশানি না করত। বোন দুটো পাড়ার বউ ঝিদের ছায়া ব্লাউজ, সালোয়ার কামিজ, ছোট ছেলেমেয়েদের জামা কাপড় সেলাই করে কিছু পয়সা আয় না করত।

তিনি থাকেন শহরের অতিশয় নিম্নবিত্ত ধরনের একটি জায়গায়। প্রায় বস্তিমতো জায়গা। একটা টিনের এক চালার মাঝখানে বাঁশের বেড়া দিয়ে দুটো রুম করা হয়েছে, এই তাঁর বাসা। সেখানে পাঁচজন মানুষ কোনও রকমে মাথা গুঁজে থাকে।

বাসা থেকে তাঁর অফিসের দূরত্ব, রিকশায় গেলে তিন টাকা। বাঁধা রেট। আসা যাওয়া ছটাকা। ছুটি ছাঁটার দিন বাদ দিয়ে মাসে কম করে দেড়শ টাকা। এই খরচটা তিনি করবেন কোত্থেকে? তাঁর মাস মাইনেই তো সাড়ে চারশ টাকা। এই সাড়ে চারশ টাকার চাকরি জোটাতেই তো তাঁর, স্বাধীনতার পর পুরো দুটো বছর, প্রতিদিন ছ সাত ঘণ্টা করে সময় বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিয়ে বেড়াতে হয়েছে।

তাঁর তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। দুবার পরীক্ষা দিয়েছেন, বিএ পাস তিনি করতে পারেননি। আইএ পাস সম্বল নিয়ে বাংলাদেশের চাকরি পাওয়া যায়! তাঁর ওপর একটা পা নেই!

এক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিল, টাইপটা শিখে ফেল, চাকরি পেতে সুবিধে হবে।

তিনি টাইপ শিখলেন। টাইপিস্টের চাকরি পেলেন। তাও ক্রাচে ভর দিয়ে ঠুক ঠুক করে কতকাল বিভিন্ন অফিসে ধরনা দেয়ার পর।

চাকরি পেতে তাঁর প্রধান অন্তরায় হয়েছিল একটি পা। যে কেউ পা দেখেই তাঁর সব যোগ্যতা নাকচ করে দিত। ওই মুহূর্তগুলো ছিল তাঁর সবচাইতে দুঃখের সময়। তাঁর তখন চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করত, তোমরা কি জান আমি আজন্ম এক পায়ের অধিকারী নই। এই সুন্দর দেশটি তোমাদের হাতে তুলে দিতে গিয়েছিলাম আমি। তোমরা তা পেয়েছ কিন্তু আমাকে হারাতে হয়েছে একটি পা।

কখনও চেঁচিয়ে ওঠা হয়নি তাঁর। কখনও বলা হয়নি এইসব কথা। মনের সব কথা মনেই রয়ে গেছে।

তবু এই চাকরিটা তাঁর হয়েছিল। একজন দয়া করে পাইয়ে দিয়েছিল। তিনশ টাকা মাইনেয় ঢুকে এখন সাড়ে চারশ। এই সাড়ে চারশ টাকা এখন তাঁর জীবনের চেয়েও মূল্যবান। প্রতিটি পাই পয়সা তাঁকে নিখুঁত হিসাব করে চলতে হয়। সুতরাং রিকশায় চড়ার ক্ষমতা কোথায় তাঁর। পায়ে হেঁটে অফিস করেন তিনি। একটা পা নেই বলে স্বাভাবিক মানুষের মতো হাঁটা চলা করতে পারেন না। যেটুকু পথ হাঁটতে একজন স্বাভাবিক মানুষের বিশ মিনিট সময় লাগে, সেখানে তাঁর লাগে এক ঘণ্টা।

সকাল দশটায় তাঁর অফিস। অন্য লোকেরা দশটার অফিস করতে বেরয় সাড়ে নটা পৌনে দশটায়। তাঁকে বেরোতে হয় সাড়ে আটটায়। ক্রাচে ভর দিয়ে, ঘামে নেয়ে তিনি যখন অফিসে পৌঁছান তখন দশটা বাজতে পাঁচ দশ মিনিট বাকি থাকে। ছুটির পর অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে তাঁর সন্ধে বয়ে যায়। চাকরিটাকে তিনি প্রাণের চেয়েও অধিক মায়ায় আঁকড়ে ধরে আছেন। এক মিনিট লেট করে কখনও অফিসে যান না। ছুটির এক মিনিট আগে অফিস থেকে বেরন না। অল্পবিস্তর শরীর খারাপ পাত্তা দিয়ে একটি দিন ছুটি নেন না। হাতে কোনও কাজ জমতে দেন না। খটাখট টাইপ রাইটার চালিয়ে যান। টাইপ রাইটারের খটাখট শব্দের ভেতর কখনও কখনও এতটা মগ্ন হয়ে যান, যান্ত্রিক শব্দটা আর কানে লাগে না তাঁর। সেই শব্দের ভেতর তিনি শুনতে পান স্বাধীনতা, স্বাধীনতা। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।

এই দুটো শব্দ এতটা আচ্ছন্ন করে রাখে তাঁকে, কখন হাতের সব কাজ শেষ হয়ে যায়, টের পান না তিনি। কখন অফিস ছুটির সময় এগিয়ে আসে, টের পান না।

দীর্ঘকালের চাকরি জীবনে আজ প্রথমবার লাঞ্চ আওয়ারে ছুটি নিতে হয়েছে তাঁকে। বৃদ্ধা মা অসুস্থ। মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন। ডাক্তার তিনটের সময় দিয়েছেন। দ্রুত বাসায় পৌঁছোন দরকার। এই কারণে তিনি আগেই ভেবে রেখেছিলেন, তিনটা টাকা ব্যয় হলেও রিকশায় চড়তে হবে আজ। সময়ের হেরফের হলে রোগীই দেখবেন না ডাক্তার। মাকে বাঁচান মুশকিল হয়ে যাবে।

অসুস্থ মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাটা, কাল ডাক্তারের সঙ্গে এপয়েনম্যান্ট করার পর থেকে ঘুরে ফিরে তাঁর মনে আসছিল। আজ অফিসে টাইপ রাইটার চালাতে চালাতেও মনে হয়েছে। টাইপ রাইটার চালানটাকে তাঁর বরাবরই সেই ভয়াবহ যুদ্ধের মতো মনে হয়। আসলে এও তো এক যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের তুলনায় কোনও অংশেই কম ভয়াবহ নয়। বেঁচে থাকার যুদ্ধ। এই কারণেই বোধহয় টাইপ রাইটারের শব্দে আনমনা হয়ে যেতে যেতে, খটাখট শব্দের ভেতর থেকে তাঁর কানে যখন তখন ভেসে আসে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। কখনও কখনও স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।

মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, কথাটা আজ যতবার তাঁর মনে এসেছে, ততবারই ভুল হয়ে গেছে। মনে হয়েছে শত্রুর গুলিতে গুরুতর আহত কোনও সহযোদ্ধাকে কাঁধে করে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার দায়িত্ব পড়েছে তাঁর। তিনি সেই দায়িত্ব পালনে যাচ্ছেন।

অফিস থেকে বেরিয়ে আনমনে রিকশার খোঁজ করতে করতে ক্রাচে ভর দিয়ে রাস্তার মোড় পেরিয়ে আসেন তিনি। এই সেই মোড় যেখানে রিকশার অপেক্ষায়, চেহারায় পৃথিবীর যাবতীয় বিতৃষ্ণা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই ছেলেটি।

ছেলেটির কাছাকাছি আসতেই হাওয়ায় সেন্টের মৃদু গন্ধটা পেয়েছিলেন তিনি। একটু হেঁটেই ঘামে ভিজে জেবজেবে হয়ে গেছে তাঁর শরীর। খদ্দরের পানজাবি ভিজে সেটে গেছে পিঠের সঙ্গে, বুকের সঙ্গে।

ছেলেটির কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন তিনি। আর হাঁটবেন না। এখানে দাঁড়িয়েই রিকশার অপেক্ষা করবেন। রিকশায় যখন চড়তেই হবে তাহলে আর হেঁটে লাভ কি! হেঁটে তো আর সময়মতো বাসায় পৌঁছতে পারবেন না!

ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রথমে হাঁ করে শ্বাস টানলেন তিনি। তারপর অপেক্ষমাণ ছেলেটির দিকে তাকালেন। তাকিয়ে রইলেন।

এই বয়সের ছেলেদের দেখলে সব সময়ই মুগ্ধ চোখে তাকান তিনি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের ওই বয়সটায় ফিরে যান। এরকম বয়স একদা তাঁরও ছিল। তখন দেশটা ছিল পরাধীন। এরা পরাধীন নয়। স্বাধীন দেশের সুখী যুবক। তারা ছিল পরাধীনতায় দুঃখি।

কিন্তু ছেলেটাকে কেমন চেনা চেনা লাগে তাঁর। কোথায় কার চেহারার সঙ্গে যেন মিল। ছেলেটাকে কোথায় দেখেছেন তিনি! কোথায়? কার চেহারার সঙ্গে মিল!

কার?

মনে পড়ে, সব মনে পড়ে তাঁর।

ছোট্ট একটা গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি বললেন, এই যে আপনি...

ছেলেটি বিরক্ত হয়ে তাঁর দিকে তাকাল। একপলক তাকিয়ে তাঁর পোশাক আশাক, চেহারা এবং ক্রাচ দেখে নিল।

তিনি বুঝতে পারেন ছেলেটি তাকে পথের ভিখিরি টিখিরি কিংবা ওরকম কিছু ভাবছে। তিনি কিছু মনে করলেন না। ভারি, পুরুষালী গলায় বললেন, মানে তুমি রেন্টু না? মনির ভাই...

এ কথায় ছেলেটি একটু চমকায়। কিন্তু মুখের বিরক্ত ভাবটা বদলায় না তার। বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে চিনতে পারলাম না।

তিনি মৃদু হেসে বললেন, আমি হেলাল।

ছেলেটি চিনতে পারল না। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

হেলাল বললেন, রেন্টু, তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ। আমি তোমাকে অনেক ছোট দেখেছি। হাফপ্যান্ট পরা। কতদিন তুমি আমার কাঁধে চড়েছ।

রেন্টু কথা বলে না। মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যায় হেলালের এসব কথা একদম ভালো লাগছে না তার।

হেলাল সব বুঝতে পারেন। ছেলেটি রেন্টু না হয়ে অন্য কেউ হলে হয়তো আর কথা বলতেন না তিনি। কিন্তু রেন্টুর সঙ্গে না বলে পারবেন কেমন করে! তাছাড়া একটি কথা তো তাঁকে জানতেই হবে। এতকাল পর একটি সূত্র পেয়েছেন। তার কথা জানবেন না! সে কোথায় আছে, কেমন আছে!

হেলাল একটু থেমে বললেন, মনি কোথায় আছে?

আপা তো স্টেটসে। দুলাভাই ওহাইয়ো ইউনিভার্সিটিতে আছেন। এসোসিয়েট প্রফেসর।

বাচ্চাকাচ্চা?

একটি মেয়ে।

দেশে আসে না?

বছর পাঁচেক আগে একবার এসেছিল। আগামী বছর আবার আসতে পারে।

শুনে হেলালের বুক তোলপাড় করে একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রেন্টু তা খেয়াল করে না।

হেলাল এক সময় বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন রেন্টু?

রিকশার জন্য।

এ সময় রিকশা পাওয়া মুশকিল।

রেন্টু এ কথার কোনও জবাব দিল না।

হেলাল বললেন, কোথায় যাবে?

যাব এক জায়গায়। গার্লফ্রেন্ড ওয়েট করছে।

শুনে মনে মনে হাসলেন হেলাল। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা খুব স্ট্রেট ফরোয়ার্ড। যে কোনও কথা সরল উচ্চারণে দীপ্তভাবে বলে দেয়। কোনও ভান ভনিতা নেই, মিথ্যাচার নেই। অথচ হেলালদের এই বয়সে সত্যকথা সরলভাবে বলার সাহস ছিল না। গার্লফ্রেন্ড কাকে বলে তাঁরা জানতেন না। তাঁরা জানতেন প্রেমিকা। হেলালের ছিল মনি। কিন্তু মনির কথা হেলাল ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানত না। দেখা হলেও তাঁরা বেশি কথা বলতে পারতেন না। তাদের যাবতীয় কথা হতো চিঠিতে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি প্রেমপত্র লেখে! ওদের কি একজন মাত্র প্রেমিকা থাকে! স্বাধীনতা কি তাহলে এই জেনারেশানের ছেলেমেয়েদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে! পুরনো মূল্যবোধগুলো কি ওরা একদম ভেঙেচুরে দিয়েছে!

শাবাশ! এই তো স্বাধীনতা!

হেলালের মুখে এক টুকরো মোহন হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু মুহূর্তেই আরেকটি অমোঘ প্রশ্ন এসে আঘাত করে তাঁকে। রেন্টুরা কি মনে রেখেছে, ওদেরকে আজকের এই সুন্দর জীবনে পৌঁছে দেয়ার জন্য দেশের মানুষ মেতে উঠেছিল ভয়াবহ এক যুদ্ধে।

হেলাল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একাত্তরে তিনি তাঁর পিতাকে হারিয়েছেন। হেলালকে খুঁজতে এসে না পেয়ে তার পিতাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান আর্মি। পিতা আর ফিরে আসেননি। যুদ্ধ থেকে হেলাল ফিরে এসেছিলেন একটি পা হারিয়ে। ফিরে এসে দেখেছিলেন তার প্রেমিকা অন্যের স্ত্রী হয়ে গেছে। পিতাহীন সংসার এলোমেলো হয়ে গেছে। এবার তাকে সংসারের হাল ধরতে হবে।

হেলাল তখন বিএ ক্লাসের ছাত্র। সামনে তার সুন্দর ভবিষ্যৎ ছিল। হলো না, সুন্দর ভবিষ্যতে যাওয়া হলো না হেলালের। সংসারের ঘানি টানার ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনাটাও চালিয়ে ছিলেন কিছুদিন। হলো না, পর পর দুবার পরীক্ষা দিয়েও পাস করা হলো না। পাঁচজন মানুষের সংসার টেনে কেমন করে হবে! কিন্তু এসব নিয়ে হেলালের কোনও দুঃখ নেই। স্বাধীনতার জন্য কিছু না কিছু ত্যাগ তো করতেই হবে।

হেলাল ভাবেন, এইভাবে ভাবেন। রেন্টুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেও ভাবছিলেন। এই কথাই ভাবছিলেন। তখন একটা খালি রিকশা এগিয়ে আসছিল তাদের দিকে। রিকশাঅলার আয়েশি ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় এইমাত্র রিকশা নিয়ে বেরিয়েছে। খালি রিকশা দেখেই মায়ের কথা মনে পড়েছে হেলালের। মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সময় হয়ে আসছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে রিকশাটা ডাকতে যাবেন হেলাল তার আগেই রেন্টু লাফ দিয়ে রিকশায় চড়ে বসল। যাও।

হেলাল কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলেন রিকশাটা দ্রুত চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। তবু দুঃখিত হতে পারলেন না হেলাল। ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে মনে রেন্টুদের উদ্দেশ্যে বললেন, সুখে থেকো, সুখে থেকো। তোমাদের সুখী করবার জন্যই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম আমরা। স্বাধীনতা এনেছিলাম। আমাদের অনেক কিছু হারাতে হয়েছে। তোমাদের যেন কোনও কিছু হারাতে না হয়।

দুপুরের মৃদু হাওয়ায় টলমল করে নড়ছিল হেলালের পাজামার একটা পা।

সর্বশেষ খবর