শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশাল ভাস্কর্য

গল্প ♦ বিপ্রদাশ বড়ুয়া

বিশাল ভাস্কর্য

রাজী বলল, পঙ্গু হওয়ার পর তাজুল স্বপ্ন দেখত সে পূর্ব জার্মানির হাসপাতালে শুয়ে আছে, সেবিকা মারিয়া রেমার্ক তার বিছানায় পাশ ঘেঁষে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে হাতের ব্যান্ডেজ ঠিক করে দিতে দিতে। ইনজেকশন দিচ্ছে, ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছে আর বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে তাকে আলিঙ্গনে বেঁধে রেখেছে ইউরোপের প্রখর শীতের রাতে। ভালো হয়ে উঠছে সে, এক পা সুস্থ ও সবল, শুধু বাঁ হাতখানা নেই। তাতে কী আসে যায়, এক হাত ছাড়া পৃথিবীতে অনেক মানুষ অসাধারণ সব সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছে। নাইবা থাকল একখানা হাত বা পা, বুকটা তো আছে অক্ষত, হূিপণ্ড আছে তরতাজা তরবারির মতো সবল। চমৎকার কাজ করছে ফুসফুস, রক্ত সঞ্চালন তন্ত্র যুকৃৎ ও পরিপাক যন্ত্র। মারিয়া ভালোবাসা দিয়ে ভালো করে তুলেছে তার হতাশগ্রস্ত হৃত্যন্ত্র।

আসলে আমিই তার বুকে মলম মেখে দিচ্ছি। আহতদের সঙ্গে দেশের হাসপাতালে পাঁচটি বছর কাটানোর পর আর একদিনও স্বপ্ন দেখেনি সে। কাকে নিয়ে দেখবে। তাজুদ্দিন নেই, বঙ্গবন্ধু হেঁটে হেঁটে কোথায় চলে গেছেন। আর স্বপ্ন কোথায়! শুধু কোথা থেকে এসে আমিই নাকি সব এলোমেলো করে দিয়েছি। তা না হয় হলো, বোন লারার ডাকে সাড়া দেয় না কেন! বাড়ি থেকে আসা বোনটির সঙ্গে কিছুতেই দেখা করতে চায় না। সেগুনবাগিচার পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলে ঢাকা দেওয়া বাড়ি থেকে আনা পিঠাগুলো গলে যায়। খেজুরের রসে ভেজা পিঠা আরও রসসিক্ত হয়। ফিরেও তাকায় না তাজুল। বোনের কান্না ঠিকই শুনতে পাচ্ছে, বুকের হাড় কাঁপছে তাও দেখতে পাচ্ছে—হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসও নড়ছে সেই কান্নায়। তবুও নীরব। ডাকলাম, তাজ চোখ খোল, না খাও তো অন্তত কথা বল। লারার সঙ্গে একবার কথা কও। ওকে তুমি বোন নাইবা ভাবলে, দেশের মুক্তিযোদ্ধাপ্রেমী অসংখ্য বোনের মতো হলেও সৌজন্যমূলক কথা বল। কেউ তোমার অটোগ্রাফ নেয়নি জানি, সে তাজ তোমার স্বাক্ষর নিতে এসেছে মনে কর না হয়, খাতাটি দেখ, প্রথম পৃষ্ঠায় সে তোমার সইটি অক্ষয় করে রাখতে চায়। দেশের কোনো ছাত্র, কোনো ছাত্রী কোনো আহত মুক্তিযোদ্ধার অটোগ্রাফ নেয় না বলে তোমার অত অভিমান করে কী লাভ বল? আমাদের মানসিকতা ওলোট-পালোট হয়ে গেছে, আবার আমরা অতীকে ফিরে যাচ্ছি ভাবছ? মানুষ অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ায়, সেখান থেকে নক্ষত্রের দেশে পাড়ি দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জয় করে। দেশ থেকে দেশান্তরে যাওয়া মানুষের সুইচ্ছা। কিন্তু আমরা ক্রমে ক্রমে ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছি, কুনো ব্যাঙের মতো, কুয়োর ব্যাঙের মতো, গুহার ছত্রাকের মতো, জানালার গোবরাটের ময়লার মতো। হ্যাঁ মুক্তিযোদ্ধার জন্য স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ঔত্সুক্য হারিয়ে যাবে কেন? প্রশ্ন করলে তারা উত্তর দেবে কি! শিক্ষকেরাই বা কতটুকু জানে বলছ? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা? থাক সে কথা। তাজুল শোন। তোমার বোন দিলারা বা লারা না জানি কী অঘটন ঘটিয়ে বসে! কানে কানে বলছি শোন, তোমার কথা না বলার অভিমানে সে যদি আজ রাতে এই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা আবাসনে আত্মহত্যা করে বসে? সে যদি আর ঘরে ফিরে না যায়? সে যদি আজ তোমার বোন পরিচয় দিতে না পারে তবে তার লজ্জা রাখবে কোথায়? ও তোমার জন্য মায়ের বানানো পিঠা, পায়েস আর বিন্নি চালের ভাত নিয়ে এসেছে। বারান্দায় শুয়ে পড়েছে। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলনি কেন? কিসের অভিমান? কেন? মাকে গিয়ে সে কী বলবে, পাড়া পড়শীদের কি শোনাবে! বাড়ি ফিরে গেলে পাড়ার সবাই তাকে ঘিরে ধরবে। তোমার ছোট্ট গ্রামখানির জন্য লারার এই আসাটাই মস্ত বড় ঘটনা। কোথায় দিনাজপুর আর কোথায় ঢাকা! লারার আসার সময় সবাই তাকে এগিয়ে দিয়েছে দু চোখ দিয়ে, ফেরার পর তেমনি আবার আগ বাড়িয়ে আসবে। গ্রামের চেয়ারম্যানকে তুমি যেমন পছন্দ কর না, গ্রামের অনেকেও করে না। রিলিফ দেওয়ার সময় এলে সে তৎপর হয়ে ওঠে লাভের গুড়ের জন্য। ওই কাজের বিনিময়ে খাদ্য দেওয়া তো! ছিটেফোঁটা গম বিলাবে। খালকাটা তো! সব তো আর গাব করতে পারবে না, কিছু কিছু তো জনগণকে বিলাতেই হবে। এ দেওয়াটুকু তার মূলধন, এটুকু দেখিয়ে সে জনসেবার রাস্তা মাপবে। আবার চেয়ারম্যান হতে চাইবে। ওর জন্য তুমি অত ভাবছ কেন! তাজুল শোন, তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আসমা। ওকে আমি প্রতিদিন ভোরে স্মরণ করি। সে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পত্নী সে, তার তেজ তো দেখনি, আমিইবা কতটুকু জানি আর। লড়াই করে সে তার শহীদ স্বামীর জমিজমা অধিকারে এনেছে। একা একা সে ঢাকায় আসে দিনাজপুরের অজপাড়াগাঁ থেকে। আমার স্বামীকে সে বশ করেছে বলে ভয় পেয়েছিলাম। সেসব ছেলেমানুষির দিন এখন আর নেই। তুমি যদি আমাকে ভালোবাসা দিতে তাহলে আমি বুকে ফুলিয়ে বলতে পারতাম, আমার স্বামীকে বলতাম বড় গলায়, পত্রিকায় চিঠি লিখে দেশবাসীকে জানতাম একজন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভালোবাসার মতো মহৎ কাজ আর কিছুই  নয়। আসলে স্বাধীনতার পর থেকে আমরা শত্রুর চক্রান্তের শিকার হয়ে ঘুরে মরছি, যার বিরুদ্ধে তাজুদ্দিন যুদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু করেছেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি এই রাজী অর্থাৎ আমি কোথায় ছিলাম এতদিন? আসমা আমার চোখ ফিরিয়ে দিয়েছে। একাত্তরের মার্চের কথা ভেবে দেখ, আমরা তখন শত্রুকে চিনতাম পরিষ্কার চেনা যেত।

এখন শত্রুরা মিত্রের বেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের অলিগলিতে ঢুকে পড়েছে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ করে ওদের পরাজিত করতে হবে। তুমি মুখ তোল, চোখ মেল, লারা আমাদের প্রাণের বন্ধু, তোমার ছোট ওর সম্পর্কে তোমাকে এর বেশি কী আর বলব! তোমার বৃদ্ধা মা অপেক্ষা করে আছেন পিঠাপুলি কেমন খেয়েছ, কী বলেছ জানতে। অপেক্ষায় আছেন, দাওয়ায় বসে তসবি নিয়ে তোমার মঙ্গল কামনা করছেন, আল্লাহ রসুলকে স্মরণ করছেন। পাড়া পড়শী তোমার খবরের  জন্য উন্মুখ হয়ে আছে, লারা ফিরে গেলে ওরা তোমার সব কথা খুঁটে খুঁটে জানতে চাইবে। তুমি হয়তো বলবে পাশের কামরার মুক্তিযোদ্ধাদের কেন দেখিছ না? ওদেরও দেখি ওরা খেয়েছে, মা ওদের জন্য দিয়েছেন।

সাব্বির বলেছে, তাজুল বড্ড অভিমানী ও স্পর্শকাতর। যুদ্ধের মধ্যেও ওরকম ছিল। ওর সাহস ও বুদ্ধির তুলনা হয় না। সে ছিল আমাদের প্রাণ। পরাজয় আর হতাশা শব্দ দুটি ওর অভিধানের নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে দুজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছে? তাজুল একজনকে সারা পথ একা বয়ে এনেছে। যুদ্ধক্ষেত্রের দৈহিক ও মানসিক প্রচণ্ড খাটুনির পরও তাজুল একটু দমেনি। সারা রাত সেবা করার পর পরদিন অপারেশনে না গিয়ে ক্যাম্পে পড়ে থাকবে সে রকম অধম যোদ্ধা সে নয়। শত্রুর সামনে অস্ত্র নিয়ে দুঃসাহস ভরে এলোপাতাড়ি ছুটে যাবে অমন বোকাও ছিল না। তাজুল হল তাজুল। এখন আহত, একখানা পায়ের চলার শক্তি খুইয়ে ফেলেছে। তবুও সে দুরন্ত অভিমানী। এখন কেন অভিমান তা কেউ জানে না। অভিমান তো নারীর একচ্ছত্র অধিকার—সম্পদ নয়। লারা পারেনি সে অভিমান ভাঙতে, অন্য কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে সেও এখন অভিমানী শয্যাশায়ী।

তাজুল ওঠ। লারা তোমাদের বারান্দার মেঝেতে পড়ে আছে। ছাত্রাবস্থায় তুমি যেমন অনশন ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলে, যেমন তুমি কাকে যেন ভালোবেসে তোমাদের গ্রামের জমির স্মৃতিচিহ্নিত আলের ওপর বসে বসে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছিলে যেমন করে মাছরাঙা মিনিটের পর মিনিট শিকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে পারে—বেচারি মাছরাঙা হয়তো জানেই না যে ও পুকুর মাছশূন্য ও জলাশয় মাছহীন, ও নদী মত্স্যবন্ধ্যা। সেই তাজুল তুমি, ওঠ, দু’হাত ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াও। তোমার একটা হাত নেই? একখানা পা অকেজো? তাতে কি! মন শক্ত কর, তোমাকে আমি তোমার উপযোগী কাজ দেব। তুমি তো ইচ্ছা করলে শিখতে পার। তোমার ডান হাত ভালো, তুমি উঠে বসতে পার। তুমি হুইল চেয়ার থেকে একা একা ওঠে চেয়ারে বসতে পার, হাঁটতেও পার ক্র্যাচ পরে। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী, স্বাধীনতা সংগ্রাম, গিন্বার্গের কবিতা ‘যশোর রোড’ শুনেছ তোমার সহযোদ্ধার মুখে। তুমি ইচ্ছা করলে লিখতে পার তেমন সংগ্রামী গান। লক্ষ শহীদ লক্ষ মা-বোনের সুখ-দুঃখের কথা তুমি লিখবে লিখবে লিখবে। গল্প উপন্যাসে তুমি নিজেকে ব্যক্ত করতে পার। আমাদের উৎসর্গ প্রাণ মুক্তিযোদ্ধা লেখক চাই।

তাজুল হঠাৎ কেঁপে উঠল। চোখ দুটি বন্ধ। চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু। ঠোঁট ঘনসংবদ্ধ। কাত হয়ে টান টান পড়ে আছে। মুখটি গোঁজা বালিশে। কখন কাত হয়ে গেল! কখন কাত হলে! এতক্ষণ তো তোমার মুখ দেখতে পাইনি। কবে তুমি পাশ ফিরলে! কী বললে? লারাকে ডাকব?

লারা লারা! দিলারাকে ডাকল রাজী। গলা ফুটে শব্দ হলো না। আবার ডাকল, লারা লারা! লারা দেখে যাও, তাজ তোমাকে ডাকছে, অভিমান ঝেড়ে ফেলেছে, তোমাদের ওপর রাগ ক্ষোভ নেই।

এক্ষুণি তাজুল বুঝি মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে না করল। সত্যিই না করল! পাশের কামরা থেকে সাব্বির ছুটে এলো ক্রাচে ভর দিয়ে। তাজুলের কক্ষের অন্য দুজন সঙ্গী এতক্ষণ বাইরে বা বারান্দায় বা অন্য কোনো কামরায় ক্যারম বা তাস পিটছিল হয়তো। তারাও ছুটে এলো। সুপার এলেন, এ সময় নিয়মমাফিক আসেন বলে। সাব্বির এলো হয়তো মনের কোণে কোনো গোপন সাড়া পেয়ে। সঙ্গী দুজনও এলো বোধহয় অন্তরের টানে। সহমর্মীদের মনে মনে অনেক কিছু গোপনে বলাবলি হয়ে যায়! হয়তো তাই, তাই হয়তো। রাজীব ডাক শুনে লারা আরও ভেঙে পড়ল। বারান্দায় এলিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। না, দৌড় দেয়নি সে, ছুটে যাওয়ার কথাও ভাবেনি! সে বুঝি সব শেষ গেছে বুঝতে পারল? আর তাজুলের মা? জানি না। জানি না কবরে শুয়ে থাকা তাজুলের বাবা এই ঘটনায় পাশ ফিরে শুয়েছিলেন কিনা। মা দৈনন্দিন চিন্তার ফাঁকে চমকে উঠেছিলেন হয়তো। মা তো মায়ের মনে সন্তানের অমঙ্গল বার্তা আপনা আপনি বেগে চলে যায়। তাজুদ্দিনের মাটি হওয়া ঝাঁজরা শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠেছিল কিনা কে জানে! সৈয়দ নজরুল? বঙ্গবন্ধুর কথা একেবারে আলাদা! তার সহিষ্ণু হৃদয় প্রতিটি বিপদাপদের সময় কেঁদে ওঠে, রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের সময় এখনো তার প্রতিটি রোমকূপ কেঁপে ওঠে।

তাহলে লারা কি বুঝতে পারল সব শেষে হয়ে গেছে। মা কি কাজের মাঝে হঠাৎ করে সব ফেলে পাথরের মতো ঠায় বসে পড়ল, ঝড়ের শেষে প্রকৃতির মতো নিস্তব্ধ নিঃসাড় হয়ে গেল, গুলিবিদ্ধ শীতের পরিযায়ী পাখির মতো আকাশ থেকে পাখ খেয়ে হতভম্ব লুটিয়ে পড়ল, যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মতো স্টেনগান হাতে তেমনি শেষ গুলিটিও প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় শত্রুর দিকে ছুড়ে মারল? মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির অতীত কোনো কোনো মুহূর্ত মানুষকে হতবাক করে দেয়, তাজুদ্দিন কি শেষ মুহূর্তেও খুন করতে আসা চেনা হত্যাকারীকে ক্ষমা ক্ষমা উচ্চারণ করেছিলেন! কেন তিনি ক্ষমা করবেন? ক্ষমা করার প্রয়োজন ছিল কি কিছু? বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা কি তার মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করেছে? তাজুদ্দিন কি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার হত্যার ঘটনার কোনো বিচার হবে না? তিনি কি জোহরা তাজুদ্দিনকে আগে-ভাগে কিছু বলে গিয়েছিলেন? নিজের ডায়েরিটা সযত্নে রেখে গিয়েছিলেন প্রিয়তমা সহযোদ্ধা পত্নীর জন্য, সেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের সূত্র রেখে গিয়েছিলেন কি? অথবা সব কথা স্পষ্ট ভাষায় পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মতো রেখা এঁকে গেছেন?

সাব্বির পাশে এসে দাঁড়াল। শেষ জীবনের আরও দুই সঙ্গী বন্ধু সাদী ও নন্দী ক্র্যাচে খুট খুট শব্দ তুলে এসে ধপাস করে বসে পড়ল লোহার খাটে। খাটও সাড়া দিল ক্যাচ ক্যাচ করে অনুগত জনের মতো, হাওয়ার ঝাপটা হঠাৎ এসে জানালায় মাথা কুটে নিল, আকাশে এক ফালি মেঘ এসে বজ্রপাত হলো, সারা শহরের মানুষ বজ্রপাতের শব্দ শুনে মুহূর্তের মধ্যে আকাশের দিকে চোখ তুলল। শহরের গাড়ি ঘোড়াও থেমে গিয়েছিল, ট্রাফিক পুলিশ হাত নামাতে ভুলে গিয়েছিল, ঘণ্টা বাজাতে ভুলে গিয়েছিল স্কুলের দফতরি পিয়ন রাস্তার অন্ধ ভিখারি হোঁচট খেয়ে তাড়াতাড়ি ভিক্ষের পাত্রটা মাথায় ধরে মওলা মওলা জপতে  শুরু করেছিল কিনা কে জানে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা কি সেদিন এক ঘণ্টার পরও বেশি সময় কর্মবিরতি পালন করেছিল! ঠিক ১০টায় সেদিন ফরাসিরা উদজান বোমা ফাটিয়েছিল দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে। নাভাদার মরু অঞ্চলে আমেরিকা পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল এ জন্যই! পাবলো নেরুদার মৃত্যুদিবস ছিল বুঝি সেদিন! মলয়সঁকে সে মুহূর্তে ফাঁসি দিয়েছিল?

লারা তবু উঠল না, ভাইয়ের কক্ষে আর গেল না, কাউকে কিছু না বলে বারান্দার যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে রইল। সে বোবা হয়ে গেছে। বড় বড় চোখ দুটি দিয়ে কী যেন খুঁজল। গ্রামের শান্ত পুকুর পাড়ের ছোট্ট ঘরের দাওয়ায় বসা মায়ের কথা মনে পড়ল। লারার এখন এ ঘর ও ঘর ছোটাছুটি করে বেড়ানোর স্মৃতি মনে পড়ার কথা ছিল, ভাই তাজুলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আগে কাটানো উজ্জ্বল-রঙিন দিনগুলো অথবা একটা ছোট্ট হলুদ পাখির কথা মনে পড়ল কি! লারা একবার ভাইকে কষে কামড়ে দিয়েছিল, তাজুলের হাত কেটে গিয়েছিল, রক্ত ঝরেছিল। একবার দুজনে ছুটে ভিটার কোণে গিয়ে সাংঘাতিক বিপদে পড়েছিল। একটা জাতিসাপের মুখে পড়ে তাজুলের কাহিল অবস্থা হয়। তারপর একটা কচ্ছপের ডিমপাড়া দেখে দুজনের কী বিস্ময়! সেই দিন-দুপুরে কচ্ছপটা ওদের দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে ছিল, কী সুন্দর মায়াবী চোখ দুটি!

মা এখন ঘরে কী করছে? লারা নাকি তাজুলের কথা ভাবছে? মায়ের কত কিছু করতে হয়, কত রকম ভয় ও ভাবনা। মায়ের মনও একেবারে অবুঝ। মা বারবার বলেছিল, দিলারা, তুই কি একা একা যেতে পারবি, তাজুলকে দেখে আসতে পারবি, যা না পিঠাপুলি নিয়ে, শীতের পিঠা ও বড় ভালোবাসে বলতে বলতে মা কেঁদে দিয়েছিল।

দিলারা বা লারা বারান্দায় বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ল। তাহলে সব শেষ? তাজুল নেই? আকাশে কি সূর্য নেই। চাঁদের কি আলো নেই! তারারা নিবে গেল!

তাজুল ঘনসংবদ্ধ ঠোঁট দুটি ফাঁক করে শেষবারের মতো কিছু বলতে চেয়ে কি কাউকে ডেকেছিল? এখন চোখ দুটি বন্ধ। চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু। ঠোঁট  চেপে বসে আছে। কাত হয়ে টান টান পড়ে রয়েছে। আগে মুখটা গোঁজা ছিল বালিশে। কখন কাত হয়ে গেল? লারা উঠল না, ভাইয়ের কামরায় গেল না, কিছু না বলে তেমনি পড়ে রইল। সে বোবা হয়ে গেছে, গোল গোল বড় চোখ দুটি দিয়ে কী যেন খুঁজল। প্রিয়তম ভাইকে, নিজের অসহায় অবস্থা দেখে নিজেকে, ভাইয়ের অভিমান ভাঙতে না পারার অভিমানে। এক অভিমানী ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে এক অভিমানী বোন এক টুকরা জ্যোত্স্নার মতো বারান্দায় পড়ে রইল।

পৃথিবীর যাবতীয় রূপ-রস সুষমা ছেড়ে একটা লোহার খাটে তাজুল পড়ে রইল। সবাই দেখল, তাজুলের শরীর আস্তে আস্তে বড় এবং বিশাল হয়ে যাচ্ছে। ঠিক দেখা হয়তো নয়, সবাই অনুভব করল তাজুলের দুটি হাত, দুটি পা শুকিয়ে যাওয়া বিশাল বক্ষপঞ্জর দীর্ঘ বাবরি কাটা চুল, আয়ত খোলা দুটি চোখ ঠিক যেন বিশাল এক ভাস্কর্য এবং বারান্দায়ও পড়ে আছে জ্যোস্নার অন্য একটি তেমন ভাস্কর্য যেন এই মাত্র উন্মোচন করে গেছেন জীবিত বঙ্গবন্ধু। তাজুল ও লারা পড়ে রইল।

সর্বশেষ খবর