শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

ছেলেবেলার ঈদগুলো

গল্প ♦ ইমদাদুল হক মিলন

ছেলেবেলার ঈদগুলো

ঈদের চাঁদ ওঠা নিয়ে সমস্যাটা আমাদের ছেলেবেলায়ও ছিল। চাঁদটা যেন সময়মতো উঠতেই চাইত না। ঊনত্রিশ রোজার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিম আকাশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও চাঁদ কোথাও দেখা গেল না কিন্তু রাতেরবেলা রেডিওর খবরে শোনা গেল দেশের অমুক এলাকায় চাঁদ দেখা গেছে, সুতরাং কাল ঈদ। সঙ্গে সঙ্গে একটা হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল বাড়িতে। সকালবেলা কী কী রান্না হবে তার প্রস্তুতি। কত রকমের সেমাই হবে, পাটালি গুড়ের পায়েসটা হবে কি না, খিচুড়ি হবে নাকি পোলাও। পোলাও হলে মাংস হবে ক রকমের? কোর্মাটা হবে কি না! এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতেন বাড়ির মহিলারা। আমরা ব্যস্ত হতাম কত সকালে ওঠা যায়। উঠে কার আগে গোসলটা করে ফেলা যায়। গোসল করে কত তাড়াতাড়ি নতুন প্যান্ট-শার্ট পরে ফেলা যায়।

নতুন শার্ট-প্যান্ট পরাটাই ছিল আমার প্রধান আকর্ষণ।

ঈদের সময় আব্বা আমাকে হাফপ্যান্ট আর শার্ট কিনে দিতেন। আমাদের সময়ে আজকের মতো ছোটরা তেমন পাঞ্জাবি পরত না। আমি অবশ্য বলছি গ্রামের কথা। সবাই শার্ট-প্যান্টই পরত। কেউ কেউ পরত পাজামা। পাজামার সঙ্গে ঝুলপকেটঅলা শার্ট।

ঈদ হতো বেশির ভাগ সময়ই শীতকালে। আর সেই সময়কার শীত মানে কী! বাপরে, ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সকালবেলা উঠে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে পুকুরঘাটে যাচ্ছি, সঙ্গে এলুমিনিয়ামের একখান লোটা কিংবা পিতলের ভারী একখান বদনা, শরীরে পানি ঢালবার আগেই ভয়ে বুক শুকিয়ে যেত।

সেই সময়কার পুকুরগুলোর পানি যে কী ঠাণ্ডা ছিল!

এই ঠাণ্ডার ভয়কে ভয় মনে হতো না নতুন শার্ট-প্যান্ট পরার লোভে। তারপর কিশমিশ পেস্তাবাদাম আর কুচি কুচি করে কাটা খোরমা দেওয়া সেমাই, পায়েস, আহ কী যে স্বাদ ছিল সেইসব খাবারের।

আমাদের গ্রামে ঈদের জামাত হতো খানবাড়ির মাঠে।

আমি বলছি বিক্রমপুর এলাকার মেদিনীমণ্ডল গ্রামটির কথা। ওই গ্রামে আমার নানাবাড়ি। বারো বছর বয়স পর্যন্ত ওই গ্রামে আমি আমার নানীর কাছে ছিলাম। মা অন্যান্য ভাইবোনকে নিয়ে ঢাকায়। ঈদের এক-দুই দিন আগে সবাইকে নিয়ে বাড়ি আসতেন আব্বা। সদরঘাট থেকে লঞ্চে চড়তেন সকালবেলা, শেষ বিকেলে মাওয়ার ঘাটে গিয়ে নামতেন।

দৃশ্যটা আমার এখনো চোখে ভাসে।

মাওয়া এলাকায় একটা পিয়নবাড়ি ছিল। সেই বাড়ি ছাড়িয়ে দক্ষিণে মিনিট পাঁচেক পায়ে হাঁটা পথ, তারপর পদ্মা। বিকেলবেলা হাজামবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি সেই নদীর তীরে। অপলক চোখে তাকিয়ে আছি পুবদিকে, কখন ওদিক থেকে এগিয়ে আসবে একটা লঞ্চ, কখন সেই লঞ্চের ডেকে দেখা যাবে আব্বা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে আমার ভাইবোনরা। মাকে দেখা যাবে না। মা বসে আছেন লঞ্চের কেবিনে।

সেই বয়সে ঈদের চাঁদ দেখার সৌভাগ্য বেশ কয়েকবার হয়েছে আমার।

চাঁদটা উঠত পুরান বাড়ি অর্থাৎ সৈয়দ মামাদের বাড়ির তালগাছটির ঠিক মাথার ওপর। আমাদের বাড়ির নতুন পুকুরটির পাড়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমে তাকালে তালগাছটির মাথার ওপর কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদটাকে যে কী সুন্দর দেখাতো। মনে হতো দৃশ্যটি বাস্তবে দেখছি না, দেখছি স্বপ্নে। আর সেই চাঁদ দেখে গ্রামজুড়ে শুরু হতো আনন্দ, হৈচৈ, চিৎকার, উল্লাস।

একবারের কথা মনে পড়ছে।

তখনো মেদিনীমণ্ডলে আমাদের পাড়াটির কোনো বাড়িতে রেডিও পৌঁছয়নি। শেষ রোজা যেদিন হচ্ছে সেদিন সকালবেলা হঠাৎ শোনা গেল গতকাল নাকি চাঁদ দেখা গেছে। সুতরাং আজ ঈদ।

কোত্থেকে কেমন করে খবরটা এলো কে জানে। বাড়িতে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। আব্বা আর আমার মায়ের চাচাতো ভাইয়েরা, মেজো নানা, ছোট নানা সবাই ছুটে গেল এখনকার ঢাকা-মাওয়া সড়ক যেটা সেই সড়ক বরাবর জাহিদ খাঁর বাড়ির ওদিকটায়। সেখানে বিশাল একটা হিজল গাছের তলায় জড়ো হয়েছেন গ্রামের মুরব্বিজনেরা।

 আমরা ছোটরাও গেছি বিপুল উৎসাহ নিয়ে। যদি ঈদটা আজই হয়ে যায় তাহলে খুবই মজা হবে। এখনই বাড়ি গিয়ে গোসল করে নতুন শার্ট-প্যান্ট আর জুতাটা পরে ফেলব।

মনে আছে, সেই সকালে অনেকক্ষণ মিটিং হলো। কানকথা শুনে আজই ঈদটা করে ফেলা ঠিক হবে কি না! বিক্রমপুরের ভাষায় কেউ বলে ফেলছে, চলেন কইরা ফালাই। ঝামেলা শেষ করি। আবার কেউ বলছে, আরে না মিয়া। যার যা ইচ্ছা কউক গিয়া, রোজা আমরা তিরিশটাই করুম। ঈদ করুম কাইল।

শেষ পর্যন্ত তাই হলো।

ঈদ হবে কাল।

আমরা হতাশ হয়ে ফিরে এলাম।

আমার ছেলেবেলার ঈদগুলো এই রকম। ঈদ কি কাল হবে, না পরশু। আর ঈদ মানে তখনকার জীবনের সবচাইতে আনন্দ আর উত্তেজনার দিন। ঈদ মানে সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিন। ঈদ মানে জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসার দিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর