শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
নিবন্ধ

বই ভাবনা

ড. নেয়ামত উল্যা ভূইয়া

বই ভাবনা

বই নিয়ে বলতে গেলে ঠিক কোন কথাটা নিতান্ত যুৎসই হবে—তা কোনো বইয়েই লেখা নেই। এতে লেখক ও বক্তার সুবিধে অবারিত। যার যার মতো করেই যুক্তি দাঁড় করানো যায়। যুক্তির শুক্তির মাঝেই বইয়ের বাণীর-মুক্তো গুপ্ত থাকে—যার মুক্তি মিলে নানান পন্থায়, নানান কায়দায়। কোনো কায়দা ফায়দা লোটে। আবার কোনো কায়দায় জ্ঞান জোটে। বই জ্ঞানের আধার, তথ্যের ভাণ্ডার। জ্ঞান পিপাসুর জন্য বই বাতিঘর। ধন লিপ্সুর জন্য বই গোলাঘর। এ বাতিঘরের জ্যোতির উদ্ভাস যাকে মোহিত করে তিনি আলোকিত মানুষ। আর গোলাঘরের ধনে যে ঝোলা ভরে সে সওদাগর; তথ্যের কারবারী। জ্ঞান চিত্তের খোরাক। ধন বিত্তের বেসাতি। জ্ঞান মন বোঝে, ধন মান বোঝে। এই মন আর ধনের যুগলবন্দী মননের মধু, উদরের অশন। উভয়ের উৎসস্থলই বই। বই আনন্দ দিলে নান্দনিক। দর্শন দিলে দার্শনিক। বিশেষ জ্ঞান দিলে বৈজ্ঞানিক। শিক্ষা দিলে শিক্ষক, দীক্ষা দিলে দীক্ষক। প্রেম দিলে প্রেমাস্পদ, স্বস্তি দিলে সম্পদ। পথ দেখালে পথিকৃত, স্বপ্ন দেখালে স্বপ্নদ্রষ্টা। দরদ দিলে দরদি, মর্ম বুঝলে মরমি। ভাব ফোটালে ভাবুক, রূপ ফোটালে রূপংকর। সত্য শেখালে সত্যানন্দ, মিথ্যা শেখালে অভিসম্পাত। প্রীতি শেখালে সখা, ঘৃণা শেখালে শত্রু।

তবে বই কিছুই নেয় না, কেবলই দেয়। বই সূর্যের সমার্থক। সূর্য আলো দেয়, বিনিময় নেয় না। বই আলো দিয়ে কালো দূর করার বার্তা দেয়, শর্ত দেয় না। বইয়ের গুণ আছে; তবে ক্ষেত্রবিশেষে নির্গুণও। মানের তারতম্য আছে বলেই পাঠক বইয়ের গুণাগুণ বিচার করে মননের এজলাশে। পাঠক নিজেই হাকিম। তার রায়ই চূড়ান্ত। এ রায়ের আপিল নেই। এখানেই বইয়ের অসহায়ত্ব। এখানেই এর সীমাবদ্ধতা। বই পরনির্ভরশীল—প্রথমত, লেখকের ভাবের রাজ্যে, দ্বিতীয়ত, পাঠকের বোধের কাঠগড়ায়। তবুও জীবন পথের পথিক যে মানুষ সেই পান্থজনের সখা একমাত্র বই। তার অগ্রগতি, প্রগতি, সমৃদ্ধি, স্বস্তি, শান্তি, আনন্দ, পুলক, সুখ, সভ্যতা, অগ্রযাত্রা, উৎকর্ষ, মহিমময়তা, সম্ভাবনা, মোহমুক্তি, নান্দনিকতা, প্রেমাকুলতা উৎসারিত হয়েছে মলাটের মোড়কে আবদ্ধ এ ছোট বস্তুটি থেকেই। তার বিষাদ, সংকট, বিলাপ, বোদন, উৎকণ্ঠা, হাহাকার, বিরহ, বৈকল্য, বিড়ম্বনা, বিপর্যয়, নৈরাশ্য, হতাশা, বিনাশ—সব ক্ষতের উপশম, সব জখমের মলম, নিরাময় প্রলেপ এ বই। বই জীবনের মতো। এর কোনো অধ্যায় হর্ষের, কোনোটা বিষাদের, কোনোটা আলোড়নের, কোনোটা মজার, কোনোটা বিলাপের। কিন্তু পরবর্তী অধ্যায়ে কী অপেক্ষা করে আছে—তা জানতে হলে তো পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখতেই হবে। হতে পারে সে অধ্যায় স্বপ্নের কিংবা সাফল্যের।

 

মনান্তরকে বা বিতর্ককে আমলে নিয়েও বলা যায়, ন্যূনতম প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে রচিত হয় প্রথম বই—যা বর্তমানে বুলগেরিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব হিস্ট্রিতে রক্ষিত রয়েছে। মাত্র ছয় পাতায় এ বইটি ২৪ ক্যারেট সোনার মলাটে বাঁধা। Strouma নদীর ধারে দক্ষিণ-পশ্চিম বুলগেরিয়ার একটি পরিত্যক্ত কবর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া যায় এটিকে। যেমন সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত ২৪ জন কবির সাড়ে ৪৬টি গান বা কবিতার সংকলন বাংলা সাহিত্যের প্রথম বই ‘চর্যাপদ’ পাওয়া যায় নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে। আর মধ্যযুগের প্রাচীন নিদর্শন বড়ু চণ্ডিদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য’ পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেলার কাকিলা গ্রামের এক গৃহস্থ বাড়ির গোয়াল ঘর থেকে উদ্ধার করেন পণ্ডিত বসন্ত রঞ্জন রায়। পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও এ কথা নিঃসংকোচে বলা যায় যে, বইয়ের অস্তিত্বের রয়েছে বহুপ্রাচীন ইতিহাস। অ্যাসেরিয় আইন বইটির রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দে। ৬৭ বর্গফুট পাথরে খোদিত এ বই কাদামাটিতে শুকনো ফলকে লেখা। এরপর বই লিখা হয়েছে পশুর চামড়ায়, গাছের বাঁকলে, প্যাপিরাসে। সহজে হাতের তালুতে রেখে পড়ার সুবিধাজনক বই পেয়েছি ১৫২৭ সালে। মুদ্রিত কাগজকে চার, আট ও ষোলো পৃষ্ঠার ভাঁজে বিন্যাসের বিষয়টি প্রচলিত হয় ফ্লানকোইস-এর হাত ধরে। বই হয় সহজে বহনযোগ্য ও পঠনযোগ্য। সর্বপ্রথম ছাপার অক্ষরে বই প্রকাশিত হয় ১৪৫০-৫৫ সালে। গোথেনবার্গের প্রকাশিত এ বইটির প্রতি পৃষ্ঠায় ছিল ৪২টি লাইন। সভ্যতার ক্রমাগত গতিধারার সঙ্গে বই এমনি করেই সারথী হয়ে আসছে যুগ থেকে যুগান্তরে।

বইয়ের বিদ্যায় বিদ্বান হয়ে কেউ যদি জ্ঞানের বারুদ দিয়ে জীবন বিনাশী বোমা বানায়, সে কসুর বইয়ের নয়, পাঠকের। শৈল্য চিকিৎসকের ছুরি ব্যামো বিতাড়নের জন্য, ব্যাধিগ্রস্থের প্রাণ রক্ষার জন্য, প্রাণ সংহারের জন্য নয়। কোনো দুর্বৃত্ত-দুরাচার যদি সে ছুরি কারও প্রাণনাশের জন্য ব্যবহার করে, তবে সে দায় চাকুর নয়; ঘাতকের, হন্তারকের, খুনির। বই যদি পাঠককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, সেটা অবশ্যই পাঠকের ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা। লেখক শিল্পী। এ শিল্পী বইয়ে তার কল্পনা ও অভিজ্ঞতার ছবি আঁকেন।

ইংরেজ দার্শনিক, কূটনীতিক, আইনজ্ঞ, বৈজ্ঞানিক চিন্তনের পথিকৃৎ স্যার ফ্রান্সিস বেকন তাঁর ‘Of Studies’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘পঠনপাঠনের ফলস্বরূপ আমরা লাভ করি আনন্দ, সৌন্দর্য ও দক্ষতা এবং প্রধানত নিনোদন। সাধারণ পরামর্শ প্রদান, পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সুষ্ঠু কর্মসম্পাদন সম্ভব হয় সেসব মানুষদের দ্বারা, যারা সুশিক্ষিত। তবে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বেশিমাত্রায় জ্ঞান ফলানো জ্ঞানীর হাস্যকর হয়ে ওঠার শামিল। পড়াশোনা আমাদের স্বভাবের উৎকর্ষ সাধন করে, আর অভিজ্ঞতা পড়াশোনাকে পরিপূর্ণতা দেয়। চতুর লোক লেখাপড়াকে অবজ্ঞা করে; নির্বোধ বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়। আর জ্ঞানী একে ব্যবহার করেন। পড়াশোনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিচার-বিশ্লেষণ ও বিবেচনাশক্তি তৈরি করা। কিছু বই চেখে দেখতে হয়, কিছু বইকে গিলে ফেলতে হয়, আর কিছু বইকে চিবিয়ে হজম করতে হয়। অর্থাৎ কিছু বইয়ের অংশবিশেষ পড়লেই চলে; কিছু বই পড়তে হয়, তবে খুব বেশি সময় নিয়ে নয়; আর কিছু বইয়ের পুরোটা পড়তে হয় এবং তা যথেষ্ট অধ্যবসায় ও মনোযোগের সঙ্গে। সংক্ষিপ্ত বই বিশুদ্ধ পানির মতো, স্বাদহীন। পড়াশোনা মানুষকে পূর্ণতা দান করে। ইতিহাস মানুষকে জ্ঞানী করে তোলে; কাব্য করে রসিক; গণিতচর্চা মানুষকে তীক্ষধী করে; প্রাকৃতিক দর্শন দেয় গভীরতা; নৈতিক জ্ঞান করে তোলে চিন্তাশীল; আর যুক্তিবিদ্যা ও আলংকারিক ভাষাচর্চা বিতর্কের সামর্থ্য বাড়ায়। পড়াশোনা মানুষের চরিত্র পাল্টে দেয়। শুধু তাই নয়, মানুষের বুদ্ধির প্রতিবন্ধকতা দূর করা যায় পড়াশোনার মাধ্যমে, যেভাবে সঠিক শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরের নানা রোগবালাই সারিয়ে তোলা যায়।’

ইতালীয় দার্শনিক ঈবপবত্ড় যথার্থই বলেছেন, ‘A room without books is like a body without a soul’. ‘বইশূন্য ঘর আর আত্মাহীন দেহ’ সমার্থক হলেও বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের অবস্থা বেশ খানিকটা সে-রকমই। আমাদের যাদের প্রাসাদ ও প্রাচুর্য আছে তাদের বিশাল বর্ণালি ড্রইংরুমও আছে। তবে মাঝে-মধ্যে তাকিয়ায় তকতকে মোড়কে দু’চারখানা বইও সাজানো দেখা যায়। বইগুলো ড্রইংরুমের বাহার বাড়ায়। সাজসজ্জায় চাকচিক্য আনে। শেলফে ওঠার পর থেকে আর সেগুলোর নামবার ফুরসৎ হয়নি। এভাবেই এরা মালিন্যের শিকার হবার আশঙ্কামুক্ত হয়েছে। রসবোদ্ধা অতিথিরা ঘরে ঢুকেই বলেন—‘বাহ কী চমৎকার ডেকোরেশন পিস! তবুও ভালো। বই নলেজ জেনারেশনের কাজে না আসলেও ঘর ডেকোরেশনের কাজে তো লেগেছে—কী সৌভাগ্য বইয়ের।

বই পড়ার গূঢ়ার্থ বোঝাতে গিয়ে তিনি সে প্রবন্ধের ইতি টেনেছেন এক জ্ঞানপিপাসু রাজা আর হেকিমের বহুপঠিত গল্পটি দিয়ে— ‘এক রাজা তাঁর হেকিমের একখানা বই কিছুতেই বাগাতে না পেরে তাঁকে খুন করেন। বই হস্তগত হলো। রাজা বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে বইখানা পড়ছেন। কিন্তু পাতায় পাতায় এমনি জুড়ে গিয়েছে, রাজা বারবার আঙ্গুল দিয়ে মুখ থেকে থুতু নিয়ে জোড়া ছাড়িয়ে পাতা উল্টোচ্ছেন। এদিকে হেকিম আপন মৃত্যুর জন্য তৈরি ছিলেন বলে প্রতিশোধের ব্যবস্থাও করে গিয়েছিলেন। তিনি পাতায় পাতায় কোণের দিকে মাখিয়ে রেখেছিলেন মারাত্মক বিষ। রাজার আঙ্গুল সেই বিষ মেখে নিয়ে যাচ্ছে মুখে।

রাজাকে এই প্রতিহিংসার খবরটিও হেকিম রেখে গিয়েছিলেন কেতাবের শেষ পাতায়। সেটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা বিষবাণের ঘায়ে ঢলে পড়লেন। বাঙালির বই কেনার প্রতি বৈরাগ্য দেখে মনে হয়, সে যেন গল্পটা জানে, আর মরার ভয়ে বই কেনা, বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে।’

কাল সচেতন ও যুক্তিবাদী লেখক, সাহিত্য সমালোচক প্রথম চৌধুরীর অনবদ্য প্রবন্ধ ‘বই পড়া’ প্রবন্ধটি হতে পারে আমাদের পাঠ-অভ্যাস গড়ে তোলার অনন্য প্রেরণা।

‘বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক’। বই যেমন আনন্দের, তেমনি নির্মল বিনোদনের বাহনও। জীবনকে বিকশিত করতে হলে জ্ঞানার্জন করতে হবে। আর জ্ঞানার্জন করতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর সব জ্ঞানের আধার বই। সে কারণেই ওই জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে বই পড়তেই হবে। নিজেকে জানতে হলে, পৃথিবীকে জানতে হলে বই পড়তে হবে। পৃথিবীর অন্যতম বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিদিন কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। বই ছিল তার একমাত্র বন্ধু, নিত্যসঙ্গী। তিনি একদিন পাঠাগারের এক কোনায় বসে বই পড়ছেন পড়ছেন তো পড়ছেনই, বইয়ের মাঝে ডুবে একাকার হয়ে আছেন। পাঠাগার কর্তৃপক্ষ পাঠাগার বন্ধ করার সময় হলে তাকে লক্ষ্য না করে পাঠাগার বন্ধ করে চলে গেলেন। কিন্তু শহীদুল্লাহ বিরামহীনভাবে পড়ছেন, কোন সময় পাঠাগার বন্ধ করা হলো তা তিনি টেরই পেলেন না। যত বড়ই বই হোক না কেন, শহীদুল্লাহ একবারে শেষ না করে কোনোভাবেই উঠতেন না।

বইয়ের প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ, জ্ঞানের জন্য গভীর অনুসন্ধিৎসা, জ্ঞানান্বষণের অভীপ্সা জাগ্রত করবার জন্য যুগে যুগে মনীষীরা তাগিদ দিয়ে গেছেন। বই অতীতের সাক্ষ্য, বর্তমানের রূপকল্প, ভবিষ্যতের স্বপ্ন-সাধ, দিক-নির্দেশনা। জ্ঞানের অসীম সাগরের মহাকল্লোল শোনা যায় বইয়ের সসীম পাতায়। বই কেনাকে যারা অর্থহীন অর্থ-ব্যয় বলে ভাবেন— কিন্তু বই পড়ার আকুতি-আগ্রহকে লালন কমরন, তারা কিন্তু রাজপথ বাদ দিয়ে গলিপথও ধরতে পারেন। তবে এর জন্য পূর্বশর্ত হলো এ নজির হাজির করা যে, কেনার জন্য বই সুপ্রাপ্য নয়। সপ্তম শতাব্দীতে টেলেম্যান্ট দেজ রেক্স মত প্রকাশ করেন যে, ‘বই যদি বিক্রয়ের জন্য রক্ষিত না থেকে থাকে, তবে তা সংগ্রহ করা চুরি বলে গণ্য করা উচিত নয়।’ এই বই তঞ্চকতার কারণটা বোধ করি কেবল দামের জন্য নয়। তাহলে চুরির প্রবণতার উদ্ভব ঘটল কেন? বইকে তো দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাংশে এসে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। আসলে বই চুরির মানসিকতার পেছনে তখন কাজ করেছে একটি সংকীর্ণ ইচ্ছা। আর সেবা হলো বই যেন আপন ভাণ্ডারে থাকে, অন্যের কাছে না পাওয়া যায়। সুতরাং সেটা তার রেয়ার কালেকশন হবে।

আমাদের লেখাপড়া, ভাবনা-পরিকল্পনা সবই প্রযুক্তিনির্ভর। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক, টুইটার, সেলফোন, সেলফি এখন হাতে হাতে। সারা বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়—যেন বালুকণায় গোটা মাটির পৃথিবী, বিন্দুতে সিন্ধু, সসীমে হাতের তালুতে অসীমের আলিঙ্গন।

পৃথিবীর ব্যস্ততম, খ্যাতনামা, ধনকুবেররাও বই পড়েন। তাদের নিত্যদিনের পাঠাভ্যাস এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। যারা ব্যস্ততার অজুহাতে বই পড়েন না, তারা লজ্জিত হবেন বিল গেটস, স্টিভ জবস, ওয়ারেন বাফেট, বারাক ওবামার বই পড়ার কাহিনী শুনে। প্রতি সেকেন্ডে যার আয় ২৫০ মার্কিন ডলার, পৃথিবীর সেই শীর্ষ ধনী ব্যক্তি বিল গেটসও বছরে ৫০টির মতো বই পড়েন। গণিত, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে শিল্পকলা আর জীবনী ঘরানার বই পড়েন তিনি। নিয়ম করে বছরে ৫০ সপ্তাহে তিনি ৫০টি বই শেষ করেন। শুধু পড়েই থেমে থাকেন না, যেসব বই পড়েন তা নিয়ে তার প্রতিক্রিয়াও লিখেন এবং প্রকাশ করেন। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই রোমাঞ্চের পেছনে ছুটেছেন স্টিভ জবস। পাগলামো আর উন্মাদনা শব্দ দুটির সঙ্গে জবসের ছিল দারুণ সখ্য। তার জীবনের ওপর বইয়ের দারুণ প্রভাব ছিল। উইলিয়াম শেকসপিয়রের কিং লিয়ার থেকে শুরু করে হারমান মেলভাইলের মবি ডিক ছিল তার পড়ার মধ্যে প্রিয় বই। আবার কবিতা আর জীবনীসংক্রান্ত বইপত্রও নিয়মিত পড়তেন অ্যাপল প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস।

শুটিং আর সামাজিক কাজসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অপরাহ উইনফ্রে। কিশোর বয়স থেকেই নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস তার। প্রতি মাসে নিজের কাজের ফাঁকে গড়ে একটি বই পড়ে শেষ করেন তিনি। ভক্তদের নিয়ে পাঠকচক্র তৈরি করে বই পড়ায় উৎসাহ দিচ্ছেন এই টেলিভিশন তারকা। ড্যানিয়েন ডিফোর বিখ্যাত উপন্যাস ‘রবিনসন ক্রুশো’র কেন্দ্রীয় চরিত্রের জাহাজডুবি ঘটেছে। নিক্ষিপ্ত হয়েছে জনশূন্য নির্জন দ্বীপে। দুই যুগ কাটিয়ে দিলেন নিভৃত দ্বীপবাসী হয়ে। নিঃসঙ্গতার নির্যাতন তাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত করতে পারেনি। কারণ তার কাছে ছিল একটি বই। এটাই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। একাকীত্বের যাতনায় তিনি আশ্রয় নিতেন সেই পরম বন্ধুর। নিজেকে যখনই নিতান্ত অসহায় মনে হতো তখন তিনি হতাশায় না ভুগে চলে যেতেন বইটার কাছে। সে বইটি বাইবেল। ধর্মের বই হলে ক্ষতি কী! বই তো বই-ই। নীতির কথার সঙ্গে এতেও প্রীতির প্রসূন থাকে। ধর্মগ্রন্থেও সাহিত্যের স্বাদ থাকে। কাব্যরস থাকে। আনন্দের নান্দনিকতা থাকে। ক্রুশোর কাছে আছে এই একটি মাত্র বই। এ বই-ই তার একান্ত দোসর, একান্ত আপন। পড়েন গভীর আগ্রহে। ভাবেন, অনুভব করেন, অনুধাবন করেন। কথা বলেন এ বন্ধুর সঙ্গে। সংলাপ চলে এর বাণীর সঙ্গে। এভাবে দূর করেন নিঃসঙ্গতা, ঘুচিয়ে ফেলেন একাকিত্ব। এভাবেই তিনি আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়িয়েছেন। এভাবেই অন্তরে বিশ্বলোকের সাড়া জাগিয়ে জনান্তিকে থেকেও জনারণ্যের সান্নিধ্য উপভোগ করেছেন। তার জীবনের সঙ্গে আরও জীবনের সংযোগ ঘটিয়েছেন। তিনি যেন রবীন্দ্রনাথের মতোই জানতেন, ‘জীবনে জীবন যোগ করা না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর