প্রতি বছরের মতো এবারও আমাদের মাঝে উপস্থিত হতে যাচ্ছে ত্যাগ ও কোরবানির স্মৃতিবিজড়িত মহান মাস পবিত্র জিলহজ। অন্যান্য মৌলিক ইবাদতের মতো কোরবানির প্রথাও হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়েছে এবং যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরামগণ তা বাস্তবায়ন করেছেন। এর দ্বারা একজন মানুষ একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে কীভাবে মুত্তাকি হতে পারে তার তরিকাও তারা শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ কোরবানির মৌলিক উদ্দেশ্য হলো মনের কোরবানি। একজন ব্যক্তি মনের ও মালের কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের জন্য বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন’ (সুরা হজ-৩৭)। আলোচ্য আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, কোরবানির দ্বারা একমাত্র উদ্দেশ্য হলো তাঁর নৈকট্য অর্জন ছাড়া আর কিছুই নয়। কোরবানির সূচনা হয়েছিল অর্থাৎ হজরত আদম (আ.)-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে। সেখানেও তাকওয়া ও ধৈর্যের বিজয় হয়েছে। অন্যায় ও জুলুমকে বর্জন করা হয়েছে। তাকওয়া ও ধৈর্যের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুরা মায়েদার ২৭-২৮-২৯ নম্বর আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন হজরত রসুলে আরাবি (সা.) কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি তাদের আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শোনান। যখন তারা উভয়েই কিছু উৎসর্গ নিবেদন করেছিল, তখন তাদের একজনের উৎসর্গ গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহীত হয়নি। সে (কাবিল) বলল : আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। সে (হাবিল) বলল : আল্লাহ ধর্মভীরুদের পক্ষ থেকেই তো (কোরবানি) গ্রহণ করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অতঃপর তুমি জাহান্নামিদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি।’ আয়াতগুলোর মধ্যে যেমনিভাবে আল্লাহভীরুদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। অনুরূপ জালেমের পরিচয়ও সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কোরবানির বর্তমান প্রথা হজরত ইবরাহিম (আ.) থেকে শুরু হয়েছে। আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে এক মহাপরীক্ষা করেছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.) মনের কোরবানি করতে পারেন কিনা। আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পুত্র ইসমাইলকেও পরীক্ষা করেছিলেন সে নিজেকে আল্লাহর আদেশের সামনে বিলীন করতে পারে কিনা। দেখা গেল পিতা-পুত্র আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এখানেও ধৈর্য ও আল্লাহভীরুতার বিজয় হয়েছে। দেখুন সুরা সাফ্ফাতে আল্লাহতায়ালা কত সুন্দরভাবে পিতা-পুত্রের কথোপকথন উল্লেখ করছেন। ‘অতঃপর সে যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম তাকে বলল : বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আল্লাহর রাহে কোরবানি করছি; এখন তোমার অভিমত কী? পুত্র বললেন : পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়ই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম (আ.) তাকে কোরবানি করার জন্য শায়িত করল, তখন আমি (আল্লাহ) তাকে ডেকে বললাম : হে ইবরাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম জবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু (আয়াত ১০১-১০৭)। আয়াতসমূহের মধ্যে একমাত্র মহান রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশ্য ছিল মনের কোরবানি করা। মনের কোরবানিতে যখন পিতা-পুত্র শতভাগ পাস করেছেন। তখন সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতায়ালা জান্নাতি দুম্বা কোরবানির মাধ্যমে তাদের কাজের সমাপ্তি ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক অর্থে মনের কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার তওফিক দান করুন। আমিন।