শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

শরীর

সেলিনা হোসেন এর ছোটগল্প

শরীর

অন্ধকার। ঘুটঘুটে। দুটো শব্দই খুব পরিচিত হালিমার। কিন্তু এই মুহূর্তে খুব অপরিচিত মনে হচ্ছে সবকিছু।

 

অন্ধকার এখন শরীর।

হালিমার শরীর।

কখনো এমন সময় আসে যখন নিজের শরীরের দিকে তাকালে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু বোধ হয় না। নিজেকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। তখন ও চোখ খুলতে পারে না। অথচ বুঝতে পারে যে ওর শরীর নড়ছে, নিঃশ্বাস বইছে এবং ওর মনে হচ্ছে বেঁচে আছে।

কতক্ষণ যে কেটে যায়। ও চোখ খোলে। দেখতে পায় দিনের আলোয় ভরে আছে চারদিক। কিন্তু অন্ধকারের ধারণা ওর মাথা থেকে সরছে না।

গত রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার ওকে গিলে ফেলেছে। ওর আর কিছু মনে নেই। জলের তোড়ের প্রবল শব্দ। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়া ঘরের চাল। অকস্মাৎ ওর মনে পড়ে ওর একটি ঘর ছিল। ঘরে হাসেম ছিল। ওর স্বামী। ময়না ছিল। ওর দেড় বছরের মেয়ে। কোথায় ওরা? হালিমা ঘোর কাটিয়ে উঠে বসে।

আবার অন্ধকার।

হালিমা চারদিকে তাকায়। এটা কোনো ঘর নয়। শূন্য ভিটা। ঘরের চালের সঙ্গে আটকে আছে ও। একবার মনে হয় ঘরটা ওর নিজেরই। আবার মনে হয়, না, ওর ঘর নয়। ভীষণ চেনা। এ গ্রাম ও দেখেনি। জন্মের পর থেকে কখনো না।

হালিমা চালের ফোঁকর থেকে বেরিয়ে আসে।

মাথাটা ঘুরে ওঠে। আবার অন্ধকার।

পা টলে। পিপাসা পায়।

উঠোনে ভেঙে পড়ে আছে গাছ।

হালিমা দু-পা হেঁটে গাছের গোড়ায় বসে পড়ে।

হাঁটতে পারছে না। বিস্ফারিত চোখে উপড়ে আসা গাছের শেকড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেমন একটা দৃশ্য। এভাবে গাছ পড়তে দেখেনি। ঝড়েও না।

ও দু’হাতে মুখ ঢাকে। পিপাসা। ভীষণ পিপাসা। ও ভয়ে আতংকে কাঁদতে থাকে। কতোক্ষণ কেঁদেছে ও জানে না। ও মাটিতে লুটিয়ে গাছের ডালপালার মধ্যে আশ্রয় খোঁজে। নিজেকে পাতার ফাঁকে আড়াল করে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকে। সূর্য তখন মাথার ওপরে।

তবুও অন্ধকার চারদিকে।

বেলা পড়লে হালিমা পানি খাওয়ার জন্য ডোবার ধারে যায়। পানির রঙ কালো দেখে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে ও।

আশেপাশে থেকে দু’একজন লোক এগিয়ে আসে।

আপনে কোমনে আছিলেন ময়নার মা?

হালিমা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ওর মুখে কথা সরে না। ও পানি খাওয়ার কথা ভুলে যায়। মনে হয় মাথার ভেতরে স্রোতের তোড়। অন্ধকার আর পানি ছাড়া চারদিকে আর কিছু নেই।

আপনে মোগরে চেনতে পারেন নাই?

আপনেরা কারা?

মুই সদর আলী। দুলালের বাপ।

মুইতো দেহি নাই আপনেরে।

হালিমা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এইসব অচেনা মানুষের মাঝে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। শুনতে পায় একজন বলছে, মাথা ঠিক নাই।

অপরজন দু’ পা এগিয়ে এসে বলে, মুড়ি খাইবেন?

খামু। হালিমা ব্যগ্র কণ্ঠে বলে। মনে হয় এতক্ষণে দুজন লোকের কণ্ঠস্বর ওর খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে দুজনকেই ও চিনতে পারে। একগাল হেসে বলে, আপনেরা কেমুন আছেন ভাইজান? মোর গেরস্তেরে দেখছেন? মাইয়ারে? মোর ময়না?

পুরুষ দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কথা বলে না। হালিমার দিকে তাকায় না। গামছার গিঁটটু খুলে শুকনো নেতিয়ে যাওয়া মুড়ি কোলের ওপর মেলে ধরে।

তিনজন গোল হয়ে বসে।

সূর্য পশ্চিম আকাশে চলে গেছে। আর কতক্ষণ পরে হয়তো ডুবে যাবে। মুড়ি খেতে খেতে তিনজনে বিষণœ হয়ে থাকে। তিনজনের কেউই তো জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া পরিবারের কাউকে খুঁজে পায়নি। পুরুষ দুজন বিষণœতার মাঝেও গভীর দৃষ্টিতে হালিমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হালিমার চোখে জল। বিড়বিড় করে বলে, মোর ময়না, ময়না রে। আপনেরা কইতে পারেন মুই ময়না রে কই পামু?

দুজন পুরুষই চুপ থাকে। উদাস চোখে দূরে তাকায়। কোন দিক ছেড়ে কোন দিকে তাকাবে বুঝতে পারে না। ঘুরে ফিরে দৃষ্টি হালিমার মুখের ওপর এসে পড়ে। হালিমার বিষণœ, ক্লান্ত, আলোহীন চোখ, কপালের ওপর শাড়ির ফুটোটা গোল হয়ে আছে। বিষণœতার সৌন্দর্য লেপ্টে আছে হালিমার মুখে।

মুড়ি খাওয়া শেষ হলে হালিমা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, মোর মনে হয় এ যাত্রা বাঁইচা গেলাম।

তারপরে মৃদু হেসে বলে, এতবড় ঝড়েই নেয় নাই। অহন আর নেবে কেডা? মোর গেরস্ত যে কোমনে? কোনহানে খুঁজমু?

এবারও কেউ কথা বলে না। গামছা ঝেড়ে কাঁধে রাখে সদর আলি। হালিমা নিশ্চুপ বসে থাকে। শাড়ির আঁচলটা বারবারই মাথার ওপর টানে। যেন ওর এ ছাড়া কিছু করার নেই। ওর চারদিকে আবার অন্ধকার।

সদর আলি বলে, মোরা যাই।

হালিমা ঘাড় কাত করে সায় দেয়।

আপনে রাইতে কোমনে থাকবেন?

হালিমা আঙুল উঁচিয়ে ভাঙা চাল দেখায়। তারপর বিড়বিড় করে বলে, মোর গেরেস্ত কোমনে পামু?

মোরা গেলাম।

পুরুষ দুজন হালিমার প্রশ্নে বিরক্ত হয়। হাঁটতে হাঁটতে একজন আর একজনকে বলে, ক্যাবল গেরস্ত আর গেরস্ত। বেডা কি আর বাঁইচ্যা আছে। মইরা ভূত অইছে।

হা-হা করে হাসে। হালিমা অন্ধকারের ডুবতে থাকে। মনে হয় লোকদুটো ভূতের মতো হাসছে। ওদের হাসিতে বুকের তলে ভয় জমে। এত বড় একটা ধ্বংসের পরও লোক দুটো মানুষের হাসি হাসে না। ভয়ে হালিমার ভেতরটা কুঁকড়ে যায়। ও গুটিগুটি পায়ে ধসে যাওয়া ঘরের চালের ভেতরে ঢোকে। বাঁশের চল্লা জোড়া লাগিয়ে খানিকটুকু যাওগা বানিয়ে শুয়ে পাড়ে।

সন্ধ্যা নামে। রাত বাড়ে। তার চিরচেনা গাঁয়ের মতো ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক নেই। শেয়াল-কুকুর ডাকে না। হাট-ফেরতা লোকের গলাও পাওয়া যায় না। হালিমার সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ও কিছু একটা শব্দ পেতে চায়। ও দু’কান খাড়া করে রাখে। ভাবে, শব্দও অন্ধকার হয়ে গেছে।

কতক্ষণ পরে বাইরে খসখস শব্দ হয়। কেউ একজন ডাকে,

ময়নার মা।

চমকে ওঠে হালিমা। ওর গেরস্ত কি? না, এটা ওর গেরস্তের গলা না। অন্য মানুষ। আবার ডাক।

ময়নার মা।

হালিমা তখন বুঝে যায় যে এটা সদর আলির কণ্ঠ। ওর শরীর স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর শরীরটা অন্ধকারের পাথর। ও নিঃসাড় পড়ে থাকে।

ময়নার মা।

আবার ডাক আসে।

ওই ময়নার মা। চোতমারানি কথা কস না ক্যান?

গলা খসখসে। স্বর উঁচুতে উঠে যায়।

হালিমা বিড়বিড় করে, অন্ধকার।

ঝড় নাই, জলোচ্ছ্বাস নাই। নির্মেঘ আকাশ।

খানকি মাগি, খাড়া দেহাইতাছি মজা। পলাবি কোমনে!

হামাগুঁড়ি দিয়ে পুরুষ দুজন ভেতরে ঢুকতে থাকে।

ওরা ভাঙা চালের খড় এবং বাঁশের চল্লা সরায়। গাছ পড়ার শব্দ। হুড়মুড় হুড়মুড়। হালিমা শক্ত করে একটি বাঁশের চল্লা ধরে।

মনে হয় বড় বড় গাছগুলো শেকড় উপড়ে পড়ে যাচ্ছে। ও ধসে পড়া চালের এক প্রান্তে

বাঁশের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নেয়।

ও বুঝতে পারে পানির তোড় ছুটে আসছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

হালিমা বুকের ভেতর থেকে উঠিয়ে আনা নিঃশ্বাস প্রবল শক্তিতে অন্ধকারের দিকে ছেড়ে দেয়।  তারপর দম নেয়। ও নিজেকেই বলে, সাইক্লোন মারতে পারেনি। আমাকে আর মারবে কোন বানচোত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর